দৈনিকবার্তা-ঢাকা,৩ নভেম্বর: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তাঁর সরকার মানবতাবিরোধী অপরাধে দন্ডিত সব যুদ্ধাপরাধীর রায় কার্যকর করবে৷এর মধ্য দিয়ে তাঁরা জাতিকে অভিশাপমুক্ত করবেন৷ সোমবার বিকেলে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন৷ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের খুনিদের বিচার করে বাংলার মানুষকে অভিশাপমুক্ত করেছি৷ ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধের বিচারের রায় কার্যকর করেও জাতিকে অভিশাপমুক্ত করা হবে৷
তিনি বলেন, ওয়াদা ছিল যুদ্ধাপরাধীর বিচার হবে, আমরা করেছি৷ অনেক চাপ সত্ত্বেও রায় কার্যকর হয়েছে৷ সব যুদ্ধাপরাধীর বিচার বাংলার মাটিতে হবে৷ সাপের ব্যাঙ গেলার উদাহরণ দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, জামায়াতে ইসলামী এখন খালেদা জিয়ার জন্য সাপের ব্যাঙ গেলার অবস্থার মতো হয়েছে৷ তিনি বলেন, খালেদা এখন জামায়াতকে গিলতেও পারছেন না, ফেলতেও পারছেন না৷ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০২১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্ণ হবে৷ ওই সময়ের মধ্যে দেশকে মধ্য আয়ের দেশ হবে৷ বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে৷ শেখ হাসিনা প্রশ্ন তুলে বলেন, জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষক হলে ৭৫ এর খুনিদের কীভাবে পুনর্বাসন করেছিলেন৷ জিয়াউর রহমান অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেছিলেন বলে অভিযোগ করেন প্রধানমন্ত্রী৷
খালেদা জিয়ার উদ্দেশে শেখ হাসিনা বলেন, সরকার অবৈধ হলে আইপিইউতে সাবের হোসেন চৌধুরী কিভাবে নির্বাচিত হলেন? মার্কিন কংগ্রেসে বিনা প্রতদ্বন্দ্বিতায় কংগ্রেসম্যান নির্বাচিত হওয়ার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী মার্কিন সরকার কি কোনো দিন অবৈধ হয়েছিল? তিনি বলেন, খালেদা জিয়া এর আগে ২০০৬ সালে বলেছিলেন আমি নাকি প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলীয় নেতা হতে পারবো না৷ ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস এখন উনি বিরোধী দলীয় নেতাও নন৷ এ সময় হেসে হেসে হাসিনা বলেন, আসলে খালেদা জিয়ার অভিশাপ আমাদের জন্য আর্শীবাদ৷
৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে বিএনপির জ্বালাও, পোড়াও এবং আন্দোলনের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আন্দোলনের নামে খালেদা জিয়ার ক্যাডাররা বাসে আগুন দিয়ে মানুষ মেরেছেন৷ তাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি গরুও৷ সড়ক কেটেছেন, রেল উপড়ে ফেলেছেন৷ খালেদা জিয়া রাস্তা করতে না পারলেও আন্দোলনের নামে রাস্তা কাটতে পারেন৷ তিনি বলেন, বিএনপি যখন ক্ষমতায় এসেছিল তখন দেশে দুর্নীতি, হত্যা, ক্যু ও বাংলাদেশ ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছিল৷ ক্ষমতা না থাকায় দুর্নীতি করতে না পারছেন না বলে খালেদা জিয়া আপসোস করছেন বলেও দাবি শেখ হাসিনার৷
যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রী করার জন্য বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সমালোচনা করে শেখ হাসিনা বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রী বানিয়েছিলেন, আমরা তাদের বিচার করছি৷ এই মাটিতে সব যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে, এটা আমার ওয়াদা৷ বিচারের রায় যা হয়েছে, তা কার্যকর করে বাংলার মাটিকে অভিশাপমুক্ত করব, ইনশাল্লাহ৷ বঙ্গবন্ধু হত্যামামলার রায় কার্যকর নিয়েও অনেকে হুমকি মোকাবেলা করতে হয়েছিল জানিয়ে সরকার প্রধান বলেন, সে রকমই সব প্রতিবন্ধকতামোকাবেলা করে যুদ্ধাপরাধের রায় কার্যকর করা হবে৷আমাদের ওয়াদা ছিল জনগণের কাছে- যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আমরা করব৷ অনেক হুমকি ধমকি..অনেক কিছু এসেছে৷ কিন্তু আপনারা জানেন, বিচার হয়েছে এবং আল্লাহর রহমতে বিচারের রায় আমরা কার্যকর করতেও সক্ষম হয়েছি৷
আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ নেয়৷ এর মধ্যে গত মেয়াদের শেষ দিকে চূড়ান্ত রায়ের পর জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার মৃতু্যদণ্ড কার্যকর হয়৷চলতি বছরের শুরুতে শেখ হাসিনা নতুন মেয়াদে ক্ষমতা নেওয়ার পর দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর চূড়ান্ত রায় হয়েছে৷ তাতে তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে৷এছাড়া যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবু্যনালের রায়ে কারাভোগের মধ্যে গোলাম আযম ও আব্দুল আলীমের মৃতু্য হয়েছে৷ ট্রাইবু্যনালে দলের নেতাদের বিরুদ্ধে দণ্ডের প্রতিবাদে জামায়াত প্রতিবারই হরতাল ডেকে আসছে৷ নিজামী, মীর কাসেম ও কামারুজ্জামানের মৃতু্যদণ্ডের রায়ের প্রতিবাদে চলতি সপ্তাহজুড়েই হরতাল ডেকেছে দলটি৷শেখ হাসিনা বলেন, আজকে জামায়াত হরতাল দেয়৷ কেন? তারা যখন মানুষ খুন করেছিল, মা- বোনের ইজ্জত লুটেছিল, গণহত্যা চালিয়েছিল, ওই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সহযোগিতা করেছিল সে সময় মনে ছিল না?
জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির রাজনৈতিক মিত্রতার দিকে ইঙ্গিত করে আওয়ামী লীগ সভনেত্রী বলেন, ওনার (খালেদা জিয়া) জন্য জামায়াত হয়ে গেছে এখন সাপের ব্যাং গেলার অবস্থা৷ না পারেন এদের পক্ষে বলতে, না পারেন এদের বিপক্ষে বলতে৷স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন, শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্বে আমরা শক্তিশালী বাংলাদেশ গড়তে চাই৷ আইনের শাসন বলেন আর গণতন্ত্রের শাসন বলেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্ব ছাড়া কোনো শাসনই সম্ভব নয়৷
তিনি বলেন,শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্বের কারণে দেশে সবচেয়ে ঘৃণিত অপরাধ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে৷ সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেন, ৩ নভেম্বরের জেলহত্যা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়৷ ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরের ঘটনা একই সূত্রে গাঁথা৷ মোস্তাক-জিয়া এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত৷ তারাই এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে৷তিনি বলেন, জিয়া, মোস্তাক ও খালেদা সরকার ৩ নভেম্বর ও ১৫ আগস্টের খুনীদের বিচার করেননি বরং হত্যাকারীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে তাদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে রক্ষা করেছেন৷
তিনি আরও বলেন, ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর ১৫ আগস্ট ও জেল হত্যাকাণ্ডের বিচার শুরু করেছেন এবং শেষ করেছেন৷ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারও তিনি শুরু করেছেন৷ তাদের বিচারও বাংলার মাটিতে শেষ করবেন৷ তাদের রায় কার্যকর হবেই এতে কোনো দ্বিধা নেই৷তিনি দেশের প্রতিটি পাড়া-মহল্লা, গ্রামে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বকে আরো শক্তিশালী করতে নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান৷
বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, জেলহত্যার এই দিনে কামারুজ্জামানের রায় একটি ঐতিহাসিক ঘটনা৷ শেখ হাসিনার সরকার থাকার জন্যই এটি সম্ভব হয়েছে৷এসময় তিনি আরো বলেন, খালেদা জিয়া একের পর এক হুঙ্কার দিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না৷তার সকল হুঙ্কার ইতোমধ্যেই ব্যর্থ হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি৷
বিএনপির সঙ্গে সংলাপের বিষয়ে তিনি বলেন, কার সঙ্গে সংলাপ? কিসের সংলাপ? কোনো সংলাপ হবে না৷২০১৯ সালের আগে বাংলাদেশের মাটিতে কোনো নির্বাচন হবে না বলেও জানান তিনি৷জিয়াউর রহমানের শাসন ব্যবস্থা অবৈধ ছিল মন্তব্য করে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, যেহেতু জিয়াউর রহমানের শাসন ব্যবস্থা অবৈধ ছিল সেহেতু বিএনপিও একটি অবৈধ দল৷শেখ সেলিম বলেন, মানবতা বিরোধী অপরাধে খালেদা জিয়ারও বিচার করা হবে৷
আওয়ামী লীগে অনেক নতুন নতুন নেতা গজিয়েছে বলে মন্তব্য আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও জাতীয় সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী৷ সোমবার বিকেলে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জেল হত্যা দিসব উপলক্ষে আওয়ামী লীগ আয়োজিত এক জনসভায় সভাপতির বক্তব্যে তিনি এ মন্তব্য করেন৷তিনি বলেন, নতুন এসব নেতাদের দিয়ে কোনো কাজ হবে না৷ এরা ক্ষমতার অংশিদারিত্ব গ্রহণের জন্য আওয়ামী লীগ করছেন৷ তিনি আরো বলেন, আমাদেরকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে৷সাজেদা বলেন, এখনো শেখ হাসিনাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে৷ কোনো ষড়যন্ত্র কাজে আসবে না বলেও উল্লেখ করেন তিনি৷
এছাড়াও জনসভায় আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ, ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীর বিক্রম, খাদ্যমন্ত্রী এডভোকেট কামরম্নল ইসলাম, স্বেচছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক পংকজ দেবনাথ প্রমুখ বক্তব্য রাখেন৷
এদিকে, জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রধানমন্ত্রীর সমাবেশস্থল থেকে অস্ত্রসহ এক আওয়ামী লীগ নেতাকে আটক করেছে শাহবাগ থানা পুলিশ৷ আটককৃত নেতার নাম আমির হোসেন৷ তিনি ৯২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি৷সোমবার বিকেল পৌনে ৩টার দিকে তাকে আটক করা হয়৷ সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রধান অতিথি হিসেবে ভাষণ দেয়ার কথা রয়েছে৷
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, কালিমন্দির গেইট দিয়ে আমির হোসেন অস্ত্রসহ সমাবেশস্থলে প্রবেশ করার চেষ্টা করছিল৷ এসময় পুলিশ তাকে তল্লাশি করলে তার কাছে একটি রিভলবার পাওয়া যায়৷ এরপর তাকে আটক করে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ৷এ বিষয়ে শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সিরাজুল ইসলাম জানান, অস্ত্রের লাইসেন্স আছে তারপরও তাকে আটক করা হয়েছে৷ কারণ প্রধানমন্ত্রীর সমাবেশস্থলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ছাড়া কেউ অস্ত্র নিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না৷প্রসঙ্গত, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গত সমাবেশের সময়েও এক নেতাকে অস্ত্রসহ আটক করেছিল পুলিশ৷
এদিকে, জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগ কর্তৃক ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত জনসভায় কাঙ্খিত পরিমাণেলোকসমাগম হয়নি৷সোমবার বিকেল ৩টায় জনসভা শুরু হয় ৷সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ধারণ ক্ষমতার দশভাগের একভাগ লোকও উপস্থিত হয়নি৷
৩ নভেম্বর জেল হত্যা দিবসে আওয়ামী লীগ এক বিশাল জনসভা করার সিদ্ধান্ত নেয়৷ আজকের জনসভা সফল করতে কেন্দ্রীয় ও মহানগর আওয়ামী লীগ একাধিকার যৌথসভা করেছিল৷সর্বশেষ গত ১ নভেম্বর আওয়ামী লীগের ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউস্থ কার্যালয়ে এক যৌথসভা অনুষ্ঠিত হয়৷ ওই সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম৷ তিনি নেতাকর্মীদের ৩ নভেম্বরের জনসভা সফল করার জন্য মাঠে নামার নির্দেশ দেন৷ সভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, ৩ নভেম্বরের জনসভা হবে স্মরণকালের সর্ববৃহত্ সমাবেশ৷তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ একটি বড় দল সে কারণে এ দলের সভা-সমাবেশেও লোকসমাগম হবে বেশি৷কিন্তু দুই দিন পর জনসভায় এসে হতাশ হয়েছেন অনেকই৷