দৈনিকবার্তা-পাইকগাছা,৮ডিসেম্বর : ৯ ডিসেম্বর ১৯৭১৷ এদিন খুলনার পাইকগাছা উপজেলার কপিলমুনি পাক হায়েনা ও তাদের দোসরদের কবল থেকে মুক্ত হয়৷ বাংলাদেশের অভু্যদয়ে তথা ৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে কপিলমুনির ভূমিকা অনস্বীকার্য৷ কপিলমুনি ছিল রাজাকারদের দুর্গ এবং শক্তিশালী ঘাঁটি৷ এ ঘাঁটির মাধ্যমে কপিলমুনি, তালা, ডুমুরিয়াসহ খুলনা ও সাতক্ষীরার বিশাল অংশ রাজাকাররা অবরুদ্ধ করে রেখেছিল৷ খুলনার ঐতিহ্যবাহী বাণিজ্যিক নগরী বিনোদগঞ্জ প্রতিষ্ঠাতা রায় সাহেব বিনোদ বিহারীর বাড়িটি ছিল রাজাকারদের ঘাঁটি৷ প্রায় ২০০ রাজাকার ও মিলিশিয়ার ছিল সশস্ত্র অবস্থান৷ সুবিশাল দোতলা ভবন, চারদিকে উঁচু প্রাচীর অনেকটা মোগল আমলের দুর্গের মতো৷ সুরৰিত দুর্গে বসে চলতো তাদের অত্যাচার৷ জোর করে গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি আনা তাদের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল৷ এলাকাটিতে হিন্দুদের বসবাস বেশি থাকায় তাদের ওপর চলতো অমানবিক নির্যাতন, ধন-সম্পদ লুট এমনকি জোর করে তাদের অনেককেই ধমানত্মরিত করে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করা হয়৷
হত্যা করা হয় শত শত মানুষকে৷ লালসার শিকার হন অগণিত মা-বোন৷ তাদের নির্যাতনের মাত্রা এতটা ভয়াবহ ছিল যে, আজো সে দিনের ঘটনা বর্ণনা দিতে গিয়ে অনেকেই গা শিঁহরে ওঠেন৷ মানুষ ধরে দেয়ালে পেরেক দিয়ে শরীর গেঁথে রাখা হতো৷ হাত-পা কেটে ছিটানো হতো লবণ৷ এমনকি বড় বড় ইট দিয়ে শরীরে আঘাত করে হত্যা করা হতো৷ নির্যাতন করে হত্যার পর গোপণ সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে লাশ পাশের কপোতাৰ নদে ফেলে দেয়া হতো৷ এক পর্যায়ে তাদের অত্যাচারে এলাকার মানুষের জান-প্রাণ হয়ে ওঠে ওষ্ঠাগত৷ এ অবস্থায় মুক্তিবাহিনী ১১ জুলাই কপিলমুনিতে প্রথম আক্রমণ চালায়৷ আরেকবার তালা থানার নকশালদের সমবেত চেষ্টায় রাজাকার ঘাঁটি আক্রমণ করা হয়৷ কিন্তু পর পর ২টি আক্রমণ আশানুরূপ ফল না হওয়ায় রাজাকারদের মনোবল বেড়ে যায় বহুগুণ৷ তাই শত্রম্ন মনে করে যে কোনো লোককে রাজাকাররা প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে ৰমতার দাপট প্রকাশ করতো৷ কপিলমুনির এ শক্ত রাজাকার দুর্গ আক্রমণের জন্য তৈরি করা হয় মহাপরিকল্পনা৷
দীর্ঘ চিনত্মাভাবনা ও খোঁজখবরের পর কপিলমুনি আক্রমণের সিদ্ধানত্ম নেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা৷ কপিলমুনি আক্রমণের পরিকল্পনা ও সশস্ত্র অংশগ্রহণ করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা গাজী রহমত উলস্নাহ দাদু (বীর বিক্রম), স ম বাবর আলী (বর্তমান পাইকগাছা উপজেলা চেয়ারম্যান), ইউনুস আলী ইনু, মোড়ল আব্দুস সালাম (মৃত), সাহিদুর রহমান কুটু, আবুল কালাম আজাদ, গাজী রফিকুল ইসলাম, কামরম্নজ্জামান টুকু, রশীদ, মকবুল হোসেন, সামাদ মাস্টার, জিলস্নুর রহমান, গাজী আনছার (শহীদ মুক্তিযোদ্ধা), খালেক, মোশারফ, আবু জাফর, খোকা, জোয়াদ্দার রসুল বাবু, ইঞ্জিনিয়ার মুজিবর, ফারুক সরদার, তোরাব, আলাউদ্দিন, কাইয়ুম, বিনয়, তৌফিকসহ বহু বীর মুক্তিযোদ্ধা৷ ১৯৭১ এর ৭ থেকে ৯ ডিসেম্বর পর্যনত্ম তাদের সুনিপুণ পরিকল্পনা ও সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে রাজাকাররা হাত উঁচু করে অস্ত্র ক্যাম্পে রেখে লাইন দিয়ে সহচরী বিদ্যা মন্দির মাঠে আত্মসমর্পণ করে৷ রাজাকার ঘাঁটি পতনের খবর পেয়ে মুহূর্তের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা আর এলাকার মানুষে পুরো মাঠ পরিপূর্ণ হয়৷ নির্যাতিত ও স্বজনহারা মানুষ এক পর্যায়ে উত্তেজিত হয়ে চড়াও হয় রাজাকারদের ওপর৷
যে যেভাবে পেরেছিল আক্রমণ করেছিল রাজাকারদের ওপর৷ পরে রাজাকার ক্যাম্প থেকে ব্যবহৃত অস্ত্র আনতে গিয়ে উদ্ধার হয় দেয়ালে পেরেক গাঁথা লাশ৷ মুক্তিযোদ্ধাদের গুপ্তচর সন্দেহে ধরে এনে তাকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়৷ জানা যায়, পেরেকবিদ্ধ ব্যক্তির নাম সৈয়দ আলী গাজী, পিতা রহিম বঙ্ গাজী, বাড়ি তালা থানার মাছিয়াড়া গ্রামে৷ এ খবর স্কুলের মাঠে পেঁৗছলে হাজার হাজার উত্তেজিত জনগণ তাদের (রাজাকার) মেরে ফেলার দাবি করে৷ জনগণের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে তাতৰণিক যুদ্ধকালীন কমান্ডাররা ১৫৬ রাজাকারকে গুলি করে হত্যা করেন৷ যা ছিল বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধকালীন ইতিহাসে ব্যতিক্রমধর্মী অধ্যায়৷ বাসত্মবায়িত হয় গণআদালতের রায়৷ কিন্তু আজো তৈরি হয়নি সহযোগী অন্য রাজাকারদের তালিকা৷ ইতিহাসের পাতায় সেভাবে লিখিত হয়নি কপিলমুনি যুদ্ধের কথা৷
উদ্ধার হয়নি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে ভারতে প্রশিৰণে জন্য যাওয়ার পথে কপিলমুনিতে রাজাকাররা ১১ ছাত্রকে হত্যার ইতিহাস৷ যতদুর জানা যায় ওই ১১ যুবক বাগেরহাটের বিভিন্ন উপজেলা থেকে এসে ছিল৷ তাদের হত্যা কারীরা আজও বেঁচে আছে বলে অভিমত এলাকাবাসীর৷ দীর্ঘ ৪৩ বছর পেরিয়ে গেলেও আজও কপিলমুনি মুক্তিযুদ্ধের অমরস্মৃতি গাঁথা স্মৃতি সত্মম্ভ নির্মাণ কাজ সম্পর্ণ হয়নি৷ গত ১৯ মে ‘১২ কপিলমুনি কপোতাৰ নদের পাড়ে ফুলতলা নামক স্থানে বধ্যভূমির স্মৃতি সত্মম্ভ নির্মাণ শুরু৷ স্মৃতি সত্মম্ভ নির্মাণ উদ্বোধন অনুষ্ঠানে সাবেকব উপজেলা চেয়ারম্যান মোঃ রশীদুজ্জামান মোড়লসহ স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের প্রধানগণ, রাজনৈতিক নেতর্ৃবৃন্দ, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিকরা উপস্থিত ছিলেন৷ পরবর্তীতে সাবেক জাতীয় সংসদ সদস্য এ্যাড. মোঃ সোহরাব আলী সানা প্রকল্পটি বাসত্মবায়নের অগ্রগতি পরিদর্শন করেন এবং প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দের প্রতিশ্রম্নতি দেন৷ কিন্তু পরতিাপের বিষয় হলো, ৩০ মাস অতিবাহিত হলেও প্রকল্পটির কাজ আজও সম্পন্ন হয়নি৷
সরেজমিনে সোমবার যে দেখা যায় স্মৃতিসত্মম্ভ সংলগ্ন কপোতাৰ নদের চর ভরাটী জায়গা একদল ভূমি আগ্রাসী দখল করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছে৷ অসম্পাত স্মৃতিসত্মম্ভ বন আর নোংরা আর্বজনার স্তুপে ঢেকে আছে৷ মুক্ত দিবস পালন নেই কোনো প্রস্তুতি৷ কপিলমুনি মুক্তি যুদ্ধ নিয়ে নতুন প্রজন্ম সহচরী বিদ্যা মন্দির স্কুল এন্ড কলেজের ছাত্র-ছাত্রী মোঃ শামীমুর রশীদ রিমন, মোঃ তাজকীর হাসান ফাহিম, তানিজ আজাদ বাঁধন ও কৃষ্ণা পাল সকলেই জানান, শুনেছি, কিন্তু সঠিক কি তা জানি না৷ এমন টি মনত্মব্য ছিল নতুন প্রজম্নের কাছে কপিলমুনি মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে৷ আর কপিলমুনি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি চিহ্ন গুলো একে একে ধ্বংস হচ্ছে৷ ভুলছে নতুন প্রজম্ন গৌরব গাঁথা কপিলমুনি মুক্তিযুদ্ধ৷ বিগত কয়েক বছরের ন্যায় এবারও মুক্ত দিবস পালনে থাকছে না তেমন কোনো অনুষ্ঠান৷ এ প্রসঙ্গে কপিলমুনি মুক্তিযোদ্ধা কল্যান সমিতির সভাপতি বীরমুক্তিযোদ্ধা সরদার ফারুক আহমেদ সাংবাদিকদের জানান, ১৯৭১ সালে আমাদের যে দায়িত্ব ছিল সেটি পালন করে কপিলমুনিকে রাজাকার মুক্ত করেছি৷ তবে মুক্ত দিবস পালনে বাধ্যবাধকতা নাই৷ মুক্ত দিবসে পতাকা উত্তোলন ও র্যালী করব৷