দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ২৩ ডিসেম্বর: একাত্তরেমানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে হবিগঞ্জের কায়সার বাহিনীর প্রধান সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছে আনর্্তজাতিক অপরাধ ট্রাইবু্যনাল-২৷ মঙ্গলবার বেলা ১২ টার দিকে এ রায় ঘোষণা করা হয়৷কায়সারের বিরুদ্ধে আনা ১, ২, ৩, ৫, ৬, ৭, ৮, ৯, ১০, ১১, ১২, ১৩, ১৪ ও ১৬ নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে৷ এর মধ্যে ৩, ৫, ৬, ৮, ১০, ১২ ও ১৬ নম্বর অভিযোগে তাকে মৃতু্যদণ্ডাদেশ দেয়া হয়েছে৷২ নম্বর অভিযোগে ১০ বছর, ৭ নম্বর অভিযোগে সাত বছর এবং ১১ নম্বর অভিযোগে পাঁচ বছর কারাদণ্ড পেয়েছেন তিনি৷ খালাস পেয়েছেন ৪ ও ১৫ নম্বর অভিযোগ থেকে৷ সাবেক প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের বিরম্নদ্ধে সুনির্দিষ্ট ১৬টির মধ্যে ১৪টি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে৷ তাকে সর্বোচ্চ সাজা মৃতু্যদন্ড দিয়ে রায় ঘোষণা করেছে ট্রাইবু্যনাল৷
এর মধ্যে ৩,৫,৬,৮,১০,১২ ও ১৬ নম্বর- এ সাতটি অভিযোগে তাকে মৃতু্যদন্ড, অভিযোগ নম্বর ১,৯ ১৩ ও ১৪ এ তাকে আমৃতু্য কারাদন্ড, ২ নম্বর অভিযোগে ১০ বছর, ৭ নম্বর অভিযোগে ৭ বছর ও ১১ নম্বর অভিযোগে তাকে ৫ বছরের কারাদন্ড দেয়া হয়৷ আনীত অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় ৪ ও ১৫ নম্বর অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দেয়া হয়৷আনত্মর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবু্যনাল-২ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল জনাকীর্ণ আদালতে আসামির উপস্থিতিতে মঙ্গলবার এ রায় দেয়৷ এটি ট্রাইবু্যনালের ১৪ তম রায় এবং ট্রাইবু্যনাল-২ এ ঘোষিত ৮ম রায়৷ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের পর এটি ৫ম রায়৷
রায়ের পর্যবেক্ষণে ট্রাইবু্যনাল মুক্তিযুদ্ধকালে নির্যাতিত বীরাঙ্গনা নারী ও যুদ্ধশিশুদের তালিকা করে তাদেরকে ক্ষতিপূরণ এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নিতে রাষ্ট্রকে উদ্যোগ নিতে বলেছে ৷কায়সারের বিরম্নদ্ধে আনীত মানবতাবিরোধী অপরাধের ১৬টি অভিযোগ হলো-অভিযোগ ১: ১৯৭১ সালের ২৭ এপ্রিল বেলা দেড়টা থেকে বিকেল ৩টার মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের পুলিশ ফাঁড়ি ও ইসলামপুর গ্রামের কাজীবাড়িতে শাহজাহান চেয়ারম্যানকে হত্যা, নায়েব আলী নামের একজনকে জখম ও লুটপাট করে কায়সার ও তার লোকজন৷ এ অভিযোগে তাকে আমৃতু্য কারাদন্ড দেয়া হয়৷৪৮৪ পৃষ্ঠার রায়ের সারাংশ পড়ছেন ট্রাইবু্যনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান৷ বিচারক প্যানেলের অন্য দুই সদস্য হচ্ছেন বিচারপতি শাহীনুর ইসলাম ও বিচারপতি মো. মুজিবুর রহমান মিয়া৷ ঘৃণিত বাহিনী ও ব্যক্তি
রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে, একাত্তরে সৈয়দ কায়সার প্রথমে হবিগঞ্জ মহকুমা শান্তি কমিটির সদস্য ও রাজাকার কমান্ডার ছিলেন৷ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি ৫০০/৭০০ স্বাধীনতাবিরোধী লোক নিয়ে নিজের নামে ‘কায়সার বাহিনী’ নামে পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতা করার জন্য একটি সহযোগী বাহিনী গঠন করেন৷ তিনি নিজে ওই বাহিনীর প্রধান ছিলেন৷ কায়সার বাহিনী’ নামাঙ্কিত এ বাহিনীর নিজস্ব ইউনিফরমও ছিল৷কায়সার এ বাহিনীর মাধ্যমে তিনি হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ বৃহত্তর কুমিল্লায় হত্যা, গণহত্যা, মুক্তিযোদ্ধা হত্যা, ধর্ষণ, হামলা, নির্যাতন, লুটপাট, অগি্নসংযোগসহ ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালান৷ তিনি পাকিস্তানি সেনাদের পথ দেখিয়ে বিভিন্ন গ্রামে নিয়ে স্বাধীনতার পক্ষের লোক এবং হিন্দু সমপ্রদায়ের ওপর আক্রমণ চালান৷রায়ের পর্যবেক্ষণে কায়সার বাহিনীকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগী বাহিনী বা অঙ্লিারি ফোর্স না বললেও ট্রাইবু্যনাল বলেন, এ বাহিনী ও সৈয়দ কায়সার ভিক্টিম ও অপরাধ সংঘটনস্থল এলাকাগুলোর মানুষের কাছে ঘৃণিত হয়ে থাকবে৷
রায় ঘোষণা উপলক্ষে আজ সকালে কায়সারকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবু্যনালে আন হয়৷ তাঁকে রাখা হয় ট্রাইব্যুনালের হাজতখানায়৷ পরে সেখান থেকে তাঁকে ট্রাইবু্যনালে আসামির কাঠগড়ায় নেওয়া হয়৷ বেলা ১১টার পর সংক্ষিপ্ত রায় পড়া শুরু করেন ট্রাইবু্যনাল৷ দুপুর ১২টা ১০ মিনিট থেকে শুরু করে সোয়া ১২টার মধ্যে ঘোষণা করা হয় দণ্ড৷ এদিকে, একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের মামলায় ফাঁসির রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে যাবেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সার৷মামলার রায় ঘোষণার পর কায়সারের আইনজীবী এসএম শাহজাহান বলেন, যেহেতু রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ রয়েছে, আমরা আপিল করব৷ আশা করি মহামান্য সুপ্রিম কোর্টে ন্যায় বিচার পাব৷প্রসিকিউশনের আনা ১৬টি অভিযোগের মধ্যে ১৪টি প্রমাণিত হওয়ায় সাবেক মুসলিম লীগ নেতা সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারকে ট্রাইবু্যনাল মৃতু্যদণ্ড দিয়েছে, যিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও হবিগঞ্জে হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণের মতো যুদ্ধাপরাধে জড়িত ছিলেন৷
তার আইনজীবী শাহজাহান বলেন, আইনজীবী হিসাবে রায়ের প্রতিক্রিয়া দেখানো যায় না৷ তবে ট্রাইবু্যনাল যেভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেভাবেই রায় হয়েছে৷তিনি বলেন, ট্রাইবু্যনালের রায়ের পর তা আপিল বিভাগে যাবে, চূড়ান্ত রায়ের পর তা পুনর্বিবেচনার সুযোগ থাকবে৷ এরপরই দণ্ড কার্যকরের প্রশ্ন আসে৷মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধে জাতীয় পার্টির সাবেক প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারকে দেওয়া ফাঁসির রায় বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধশিশুদের প্রতি উত্সর্গ করেছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা৷
প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত পরে সাংবাদিকদের জানান, কায়সারের বিরুদ্ধে আনা ১৬টি অভিযোগের মধ্যে ১৪টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে৷এর মধ্যে সাতটি অভিযোগে তার মৃতু্যদণ্ড, চারটিতে যাবজ্জীবন, দুটিতে ১০ ও ৭ বছর এবং একটিতে ৫ বছরের কারাদণ্ড হয়েছে৷ আর দুটি অভিযোগ থেকে আসামিকে খালাস দিয়েছে আদালত৷রায়ের প্রতিক্রিয়ায় জ্যেষ্ঠ এ আইনজীবী বলেন, এ রায়ে আমরা আনন্দিত৷
তিনি জানান, যুদ্ধ শিশুদের জন্য কমপেনসেশন স্কিম চালু ও তাদের পুনর্বাসনে রাষ্ট্রের ভূমিকা নেওয়া উচিত্ বলে রায়ের পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করা হয়েছে৷গত ২০ আগস্ট এ মামলার কার্যক্রম শেষে ট্রাইবু্যনাল রায় অপেক্ষমাণ রাখেন৷ সেদিন শারীরিক কারণে জামিনে থাকা কায়সারের (৭৩) জামিন বাতিল করে তাঁকে কারাগারে পাঠান ট্রাইবু্যনাল৷ মোহাম্মদ কায়সার ছিলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সরকারের সাবেক প্রতিমন্ত্রী৷
১৯৭১ সালে দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় কায়সার বাহিনী’ গঠন করে ওই দুই জেলায় যুদ্ধাপরাধে নেতৃত্ব দেন এই মুসলিম লীগ নেতা৷ জিয়াউর রহমানের আমলে তিনি হয়ে যান বিএনপির লোক, হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সময় জাতীয় পার্টির৷বিচারপতি ওবায়দুল হাসান নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ মঙ্গলবার ৭৪ বছর বয়সী এই যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ সাজার রায় ঘোষণা করে৷ট্রাইবু্যনালের অপর দুই সদস্য বিচারপতি মুজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি শাহিনুর ইসলামও এ সময় উপস্থিত ছিলেন৷৪৮৪ পৃষ্ঠার রায়ের সংক্ষিপ্তসার পড়ে বিচারক বলেন, সৈয়দ কায়সারের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের আনা ১৬টি অভিযোগের মধ্যে ১৪টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে৷
মানবতাবিরোধী অপরাধে বিচারাধীন আসামিদের মধ্যে কায়সার দ্বিতীয় ব্যক্তি, যাকে জামিনে রেখে শুনানি চলে৷ গত ২০ অগাস্ট মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখার পর তাকে কারাগারে পাঠানো হয়৷ ট্রাইবু্যনালে এ পর্যন্ত রায় আসা ১৪টি মামলার মধ্যে কায়সারসহ দুইজন একাত্তরে মুসলিম লীগের রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন, যারা পরে বিএনপির আমলে রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হন৷হবিগঞ্জের মাধবপুরের ইটাখোলা গ্রামের সৈয়দ সঈদউদ্দিন ও বেগম হামিদা বানুর ছেলে সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সার ওরফে মো.কায়সার ওরফে সৈয়দ কায়সার ওরফে এসএম কায়সারের জন্ম ১৯৪০ সালের ১৯ জুন৷নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সময় তিনি যে তথ্য নির্বাচন কমিশনকে দিয়েছেন, তাতে ঢাকার আরমানিটোলা নিউ গভার্নমেন্ট হাই স্কুল থেকে তার মেট্রিক ও জগন্নাথ কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করার কথা বলা হয়েছে৷ তবে ওই স্কুলে তার পড়ার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে ট্রাইবু্যনালকে জানানো হয়৷নির্বাচন কমিশনের নথিতে তার শিক্ষাগত যোগ্যতা বলা হয়েছে, তিনি বিএ পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন৷ কয়েকটি শিল্প কারখানাতেও তার মালিকানা রয়েছে৷
সৈয়দ কায়সারের বাবা সৈয়দ সঈদউদ্দিন ১৯৬২ সালে সিলেট-৭ আসন থেকে কনভেনশন মুসলিম লীগের এমএলএ নির্বাচিত হন৷ ওই বছরই মুসলিম লীগের রাজনীতিতে যুক্ত হন তার ছেলে কায়সার৷১৯৬৬ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত কায়সার মুসলিম লীগ সিলেট জেলা কমিটির সদস্য ছিলেন৷ ১৯৭০ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে প্রতিদ্বনি্দ্বতা করে তিনি পরাজিত হন৷
১৯৭১ সালে দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় ৫০০ থেকে ৭০০ স্বাধীনতাবিরোধীকে নিয়ে কায়সার বাহিনী’ গঠন করেন এই মুসলিম লীগ নেতা৷ তিনি নিজে ছিলেন ওই বাহিনীর প্রধান৷তিনি যে সে সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে পথ দেখিয়ে বিভিন্ন গ্রামে নিয়ে স্বাধীনতার পক্ষের লোক এবং হিন্দু সমপ্রদায়ের ওপর দমন অভিযান চালিয়েছিলেন- সে বিষয়টি মামলার সাক্ষীদের বক্তব্যেও উঠে এসেছে৷১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করার ঠিক আগে কায়সার পালিয়ে লন্ডনে চলে যান৷ দেশে ফেরেন ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর৷জিয়াউর রহমানের সময় ১৯৭৮ সালে আবারো রাজনীতিতে সক্রিয় হন কায়সার৷ ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিলেট-১৭ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটে দাঁড়িয়ে সাংসদ নির্বাচিত হন৷
পরে তিনি বিএনপিতে যোগ দেন এবং হবিগঞ্জ বিএনপির সভাপতি হন৷ ১৯৮২ সালে তিনি বিএনপির শাহ আজিজুর রহমান অংশের যুগ্ম মহাসচিবও হন৷সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সময়ে কায়সার জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন এবং হবিগঞ্জ শাখার সভাপতির দায়িত্ব পান৷ ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে হবিগঞ্জ-৪ আসন থেকে লাঙ্গল টওতীকে নির্বাচন করে আবারও দুই দফা তিনি সংসদ সদস্য হন৷ ওই সময় তাকে কৃষি প্রতিমন্ত্রীরও দায়িত্ব দেন এরশাদ৷এরপর ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে জাতীয় পার্টি থেকে নির্বাচন করে পরাজিত হন কায়সার৷ এক পর্যায়ে এরশাদের দল ছেড়ে তিনি যোগ দেন পিডিপিতে৷মামলার পূর্বাপর: গতবছর ১৫ মে কায়সারের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে ট্রাইবু্যনাল৷ ওই রাতেই গ্রেপ্তার করা হয় মুসলিম লীগের এই সাবেক নেতাকে৷ এরপর তাকে রাজধানীর অ্যাপোলো হাসপাতালে ভর্তি করা হয়৷
২১ মে পুলিশ কায়সারকে হাসপাতাল থেকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করলে বিচারক তাকে কারাগারে পাঠান৷ আসামিপক্ষের আবেদনে গতবছর ৪ অগাস্ট সৈয়দ কায়সারকে শর্তসাপেক্ষে জামিন দেয় ট্রাইবু্যনাল৷প্রসিকিউশনের তদন্ত কর্মকর্তা মনোয়ারা বেগম ২০১২ সালের ২৮ মার্চ থেকে গত বছর ২১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কায়সারের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত করেন৷এরপর ১০ নভেম্বর ট্রাইবু্যনালে কায়সারের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে প্রসিকিউশন, যাতে যুদ্ধাপরাধের ১৮টি অভিযোগ আনা হয়৷এর মধ্যে ১৬টি ঘটনায় অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে চলতি বছর ২ ফেব্রুয়ারি সৈয়দ কায়সারের বিচার শুরু করে ট্রাইবু্যনাল, যার মধ্যে গণহত্যার একটি; হত্যা, নির্যাতন, অগি্নসংযোগ ও লুটপাটের ১৩টি এবং ধর্ষণের দুটি অভিযোগ রয়েছে৷গত ৪ মার্চ প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্তর সূচনা বক্তব্যের মধ্য দিয়ে এ মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়৷ কায়সারের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাসহ প্রসিকিউশনের মোট ৩২ জন সাক্ষী৷
আসামিপক্ষের আইনজীবী তাদের সবাইকে জেরাও সম্পন্ন করেন৷ তবে কায়সারের পক্ষে কোনো সাক্ষী হাজির করতে পারেনি আসামিপক্ষ৷এরপর ২৩ জুলাই থেকে প্রসিকিউশনের পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন প্রসিকিউটর তুরীন আফরোজ, রানা দাশগুপ্ত ও তাপস কান্তি বল৷ কায়সারের পক্ষে ৭ আগস্ট থেকে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন এস এম শাহজাহান ও আব্দুস সোবহান তরফদার৷দুই পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে গত ২০ অগাস্ট মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখে ট্রাইবু্যনালচতুর্দশ রায়: বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালের ২৫ মার্চ ট্রাইবু্যনাল গঠনের মধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধের বহু প্রতীক্ষিত বিচার শুরু হয়৷ ২০১৩ সালের ২১ জানুয়ারি প্রথম রায়ে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক রুকন আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসির আদেশ আসে৷ পলাতক থাকায় তিনি আপিলের সুযোগ পাননি৷
৫ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় রায়ে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়, যা প্রত্যাখ্যান করে রাজধানীর শাহবাগে অবস্থান নেয় হাজার হাজার মানুষ৷যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে সেই আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লে জনতার দাবির মুখে সরকার ট্রাইবু্যনাল আইনে সংশোধন আনে৷ এর মধ্যে দিয়ে রায়ের বিরুদ্ধে দুই পক্ষেরই আপিলের সমান সুযোগ তৈরি হয়৷ গত ১৭ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগ এ মামলার চূড়ান্ত রায়ে কাদের মোল্লাকে প্রাণদণ্ড দেয়, যা কার্যকর করা হয় ১২ ডিসেম্বর৷
ট্রাইবু্যনালের তৃতীয় রায়ে গতবছর ২৮ ফেব্রুয়ারি জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির আদেশ হলে দলটির ঘাঁটি বলে পরিচিত এলাকাগুলোতে ব্যাপক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে৷ সরকারি হিসেবেই পুলিশসহ নিহত হয় ৭০ জনেরও বেশি মানুষ৷ওই রায়ের বিরুদ্ধে সাঈদী আপিল করলে চলতি বছর ১৭ সেপ্টেম্বর দেইল্যা রাজাকার নামে খ্যাত এই জামায়াত নেতার সাজা কমিয়ে আমৃতু্য কারাদণ্ডের আদেশ দেয় সর্বোচ্চ আদালত৷গতবছর ৯ মে ট্রাইব্যুনালের চতুর্থ রায়ে জামায়াতের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানকেও মৃতু্যদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল৷ আপিলের রায়েও গত ৩ নভেম্বর তার সর্বোচ্চ সাজা বহাল থাকে৷
মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র,পরিকল্পনা ও উসকানির দায়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন জামায়াত আমীর গোলাম আযমকে গতবছর ১৫ জুন ৯০ বছরের কারাদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল৷ এটি ছিল ট্রাইবু্যনালের পঞ্চম রায়৷রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের শুনানি চলার মধ্যেই গত ২৩ অক্টোবর রাতে হাসপাতালে চিকিত্সাধীন অবস্থায় মারা যান ৯২ বছর বয়সী জামায়াতগুরু৷গতবছর ১৭ জুলাই ষষ্ঠ রায়ে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃতু্যদণ্ড দেওয়া হয়৷এরপর ১ অক্টোবর সপ্তম রায়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও চট্টগ্রামের সাংসদ সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসির রায় আসে৷ তারা দুজনই রায়ের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করেছেন৷
গতবছর ৯ অক্টোবর বিএনপির সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীমকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয় আদালত৷ যুদ্ধাপরাধের দণ্ড ভোগের মধ্যে ৮৩ বছর বয়সে গত ৩০ অগাস্ট মারা যান আলীম৷ যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবু্যনালের রায়ের পর ১১ মাস কারাবন্দি অবস্থায় হাসপাতালের প্রিজন সেলে ছিলেন তিনি৷বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে একাত্তরের দুই বদর নেতা আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মুঈনুদ্দীনকে গতবছর ৩ নভেম্বর মৃতু্যদণ্ড দেয় ট্রাইবু্যনাল৷ তারা দুজনেই পলাতক৷দশম রায়ে গত ২৯ অক্টোবর জামায়াত আমির একাত্তরের বদর প্রধান মতিউর রহমান নিজামীকেও দেওয়া হয় সর্বোচ্চ সাজা, যিনি বাঙালি জাতিকে সমূলে ধ্বংস করতে স্বেচ্ছায় ও সচেতনভাবে’ ইসলামের অপব্যবহার করেন বলে রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়৷ তিনিও এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছেন৷একাদশ রায়ে গত ২ নভেম্বর চট্টগ্রামের আলবদর কমান্ডার মীর কাসেম আলীকে আদালত মৃতু্যদণ্ড দেয়৷ জামায়াতে ইসলামীর এই শুরা সদস্যকে দলটির প্রধান অর্থ যোগানদাতা বলা হয়ে থাকে৷গত ১৩ নভেম্বর ফরিদপুরের রাজাকার কমান্ডার জাহিদ হোসেন খোকন ওরফে খোকন রাজাকারের ফাঁসির আদেশ আসে৷আর সর্বশেষ ২৪ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রাজাকার কমান্ডার ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত নেতা মোবারক হোসেনকেও আদালত মৃতু্যদণ্ড দেয়৷