দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ২২ মার্চ: ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান টেলিভিশনে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা প্রদর্শিত হয়নি।জাতির অবিসংবিদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৩ মার্চ পাকিস্তানের জাতীয় দিবসের দিন বাংলাদেশের সর্বত্র জাতীয় পতাকার পরিবর্তে কালো পতাকা প্রদর্শনের নির্দেশ দেন। তার নির্দেশের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বাঙালী কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত টেলিভিশন অনুষ্ঠান সম্প্রচার কমিটি সেদিন টিভি পর্দায় কালো পতাকা যদিও প্রদর্শন করতে পারেনি, তবে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকাও প্রদর্শন করেনি।ওই কমিটির এক সদস্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হাসান ইমাম বলেন, ওইদিন সারাদেশে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বাঙালী কালো পতাকা প্রদর্শন দিবস পালন করে। বাসাবাড়ির ছাদে, গাছে, রাস্তায়, যার যেখানে সম্ভব হয়েছে, সেখানেই প্রতিবাদ স্বরূপ এই কালো পতাকা প্রদর্শন করে।
তিনি বলেন, সে সময় টিভি অফিস পাকিস্তানী আর্মি দ্বারা সব সময় বেষ্টিত থাকতো এবং টিভির সম্প্রচারে আমাদের কমিটির পক্ষে কালো পতাকা প্রদর্শন করা সম্ভব ছিল না বলে কমিটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ২৩ মার্চ টিভি পর্দায় পাকিস্তানের জাতীয় পতাকাও প্রদর্শন করা হবে না।হাসান ইমাম বলেন, কিন্তু সেটি কিভাবে সম্ভব হবে ? কারণ রাত ১১টায় পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা প্রদর্শনের মধ্যদিয়ে প্রতিদিনের টিভি সম্প্রচারের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়। নিয়মানুযায়ী ওইরাত ১১টায়ও জাতীয় পতাকা প্রদর্শনের মাধ্যমে সম্প্রচারের সমাপ্তি ঘোষণা করতে হবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ পালন করতে গেলে তা করা সম্ভব নয়।
তিনি বলেন, তখন আমাদের টিভি সম্প্রচার কমিটি সিদ্ধান্ত নেয় ২৩ মার্চ রাত ১১টায় টিভি সম্প্রচার বন্ধ করা হবে না। শুধু ওইদিনই টানা রাত ১২টা পর্যন্ত সম্প্রচার চালিয়ে এবং ২৪ মার্চ এই ঘোষণা দিয়ে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা প্রদর্শন করে সম্প্রচার শেষ করা হবে।বর্ষিয়ান এ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বলেন, ওই সিদ্ধান্ত মোতাবেক রাত ১১টার পর টিভির অনুষ্ঠান চলতে থাকে। তখন সেনাবাহিনীর অফিসাররা বারবার আমাদের জিজ্ঞাসা করেন অনুষ্ঠান আজ কেন শেষ হচ্ছে না ? তখন আমরা যারাই টিভি অফিসে ছিলাম, সবার মধ্যেই ভয় ও চাপা উত্তেজনা কাজ করছিল। কারণ সেনাবাহিনী যদি আমাদের কমিটির পরিকল্পনা ধরে ফেলে, তাহলে কারো আর রক্ষা নেই।
তিনি বলেন, তখন অনুষ্ঠান রেকর্ডিংয়ের কোন ব্যবস্থা ছিল না বলে টেলিভিশনের সব অনুষ্ঠানই সরাসরি সম্প্রচার করা হতো। আর এ বিষয়টিকে মাথায় রেখে আমরা পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে নানা বাহানা দিয়ে বোঝাতে লাগলাম একটি ভাল অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে, তা শেষ না হওয়া পর্যন্ত সম্প্রচার বন্ধ করা যাচ্ছে না। এভাবে ভয় ও উত্তেজনা নিয়ে রাত ১২টা পর্যন্ত অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হয়। এরপর ২৪ মার্চের ঘোষণা দিয়ে জাতীয় পতাকা প্রদর্শন করা হয়। এভাবেই ২৩ মার্চ ৭১’ আমাদের কমিটি জাতীয় পতাকা প্রদর্শন না করে প্রতিবাদ জানিয়েছিল।বেতার ও টিভি সম্প্রচারে কমিটি গঠন করা প্রসঙ্গে হাসান ইমাম বলেন, ১৯৭১ সালের ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান গণ পরিষদের সভা স্থগিত ঘোষণা করলে বাঙালী বিক্ষোভে ফেটে পরে।বঙ্গবন্ধু তখন পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগের ডাক দিয়ে ৭ মার্চের জনসভা থেকে আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচী ঘোষণার কথা জানান।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর অসহযোগের ঘোষণা দেয়ায় আমরা বিক্ষুদ্ধ শিল্পী সমাজ ১ মার্চ থেকেই বেতার ও টিভির অনুষ্ঠান বর্জন করতে শুরু করি। এ বর্জন এতটাই সর্বাত্মক হয়েছিল যে, পাকিস্তানীরা বেতার-টিভি চালাতে পারছিল না। কারণ সে সময় অনুষ্ঠান রেকর্ডিংয়ের কোন সুযোগ ছিল না বলে সব অনুষ্ঠানই সরাসরি সম্প্রচার হতো। এতে তৎকালীন বেতার ও টিভি কর্তৃপক্ষকে বেশ বেকায়দায় পড়তে হয়েছিল।এই নাট্যব্যক্তিত্ব আরো বলেন, কিন্তু ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বাঙালী জাতিকে কিছু দিক নির্দেশনা দেন এবং বেতার-টিভি খোলা থাকবে বলেও ঘোষণা দেন। তখন ওই ভাষণের পর সন্ধ্যায় তিনি, ওয়াহিদুল হক, আতিকুল ইসলাম, গোলাম মোস্তফা ও হাফিজসহ তাদের একটি গ্রুপ বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির বাসায় গিয়ে জানতে চায়, তাঁর (বঙ্গবন্ধু) নির্দেশ মেনে বেতার-টিভির অনুষ্ঠানে তারা যোগদান করবেন কিনা ? তখন বঙ্গবন্ধু তাদের বলেছিলেন-‘ তোদের কথা মত যদি বেতার-টিভি চলে তাহলে গণমাধ্যম দু’টি অসহযোগের বাইরে থাকবে, তা না হলে বেতার-টিভিও অসহযোগের আওতায় পড়বে’।
হাসান ইমাম বলেন, বঙ্গবন্ধু তখন তৎকালীন তথ্যসচিব জহুরুল হককে ফোন করেন এবং বলেন, আমার ছেলেদের পাঠাচ্ছি, ওদের কথা মত যদি বেতার-টিভি চালান তাহলে তা অসহযোগের বাইরে থাকবে, না হলে গণমাধ্যম দু’টিও অসহযোগের আওতায় পড়বে।তিনি বলেন, তারা বঙ্গবন্ধুর বাড়ি থেকে বের হয়ে ৭ মার্চ রাতেই জহুরুল হকের বাসায় যায়। সচিব তাদের বসিয়ে রাওয়াল পিন্ডির সঙ্গে কথা বলেন এবং জানান, দু’টি শর্ত মানলে তাদের হাতে বেতার-টিভির দায়িত্ব দিতে পারেন। শর্ত দু’টি হচ্ছে- পাকিস্তানের অখন্ডতা ও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কিছু বলা ও প্রচার করা যাবে না।
হাসান ইমাম বলেন, সঙ্গে সঙ্গে তারা বঙ্গবন্ধুকে ফোন করে শর্ত দু’টির কথা জানান। তখন বঙ্গবন্ধু তাদের বলেন- ‘আপাতত শর্ত দু’টি মেনে বেতার-টিভি দখল কর’।তিনি বলেন, শিল্পীদের দ্বারা গঠিত তাদের ‘বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ’ ৮ মার্চ বেতার ও টিভির কর্মকর্তা ও প্রযোজকদের সঙ্গে বসে মোস্তফা মনোয়ারকে বেতারের এবং আশরাফুজ্জামানকে টেলিভিশনের আহবায়ক করে দু’টি কমিটি গঠন করেন। এ কমিটি ৮ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনীর নাকের ডগায় বসে বাঙালী জাতীয়তাবাদের পক্ষে অসাধারণ সব অনুষ্ঠান প্রচার করে। যা মুক্তিযুদ্ধে বাঙালী জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এ সময় শিল্পীরা এসব অনুষ্ঠানের জন্য কোন পারিশ্রমিক নেয়নি বলেও তিনি জানান।