দৈনিকবার্তা-গৌরনদী (বরিশাল) , ১৫ মে ২০১৫: দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সর্ববৃহৎ গণহত্যা দিবস আজ শুক্রবার ১৫ মে। ১৯৭১ সালের এইদিনে বরিশালের উত্তর জনপদের তৎকালীন গৌরনদী ও বর্তমান আগৈলঝাড়া উপজেলার রাজিহার গ্রামের ইউনিয়নরে মধ্যবর্তী রাজিহার ও রাংতা উভয় গ্রামের সীমানায় কেতনার বিলের অবস্থান। কেতনার বিলে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ৮টি গ্রামের দেড় সহস্রাধিক নিরাপরাধ গ্রামবাসীকে গুলি করে হত্যা করে।দক্ষিণাঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে বড় এ গণহত্যার স্থানে স্বাধীনতার ৪৪বছরেও শহীদদের স্মরণে নির্মিত হয়নি কোন স্মৃতিসৌধ। ফলে এসব শহীদের শেষ স্মৃতিচিহ্নটুকু মুছে গেছে। এছাড়া শহীদের তালিকায়ও স্থান পায়নি হত্যাকান্ডের শিকার কেউ। এমনকি দীর্ঘদিনেও সরকারীভাবে দিবসটি পালন উপলক্ষে নেয়া হয়নি কোন কর্মসূচী। এবছর প্রথমবারের মত স্থানীয়ভাবে রাংতা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে আজ শুক্রবার বিকেল তিনটায় ‘গণহত্যা দিবস-৭১’ উপলক্ষে স্মরণ সভা, শহীদদের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামণায় দোয়া-মিলাদ ও প্রার্থণা সভার আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়াও দিবসটি উদ্যাপন উপলক্ষে এবারই সর্বপ্রথম প্রকাশিত হচ্ছে ‘স্মরণিকা-৭১’।
যা ঘটেছিল সেদিন : ৭১’র সালের ১ জৈষ্ঠ্য দোনারকান্দির বাসিন্দা চিত্ত বল্লভের নেতৃত্বে স্থানীয় লোকজন ঢাল-সুরকি নিয়ে পাক হানাদারদের মুখোমুখি ঝাঁপিয়ে পরে ৪জন পাকসেনাকে কুপিয়ে হত্যা করে। এ ঘটনায় গৌরনদী কলেজে পাকসেনাদের ক্যাম্পের শতাধিক পাকসেনা ক্ষিপ্ত হয়। তারা স্থানীয় আলবদর ও রাজাকারদের সহযোগিতায় কসবার হযরত মল্লিক দূতকুমার পীর সাহেবের মাজার সংলগ্ন রাস্তা দিয়ে চাঁদশীর পশ্চিমদিকে অগ্রসর হয়ে জনতার ওপর এলএমজির ব্রাশফায়ার করে পাখির মতো মানুষ মারতে থাকে। পাকসেনাদের ভয়ে সেদিন চাঁদশী, রাংতা, রাজিহার, চেঙ্গুটিয়া, টরকী, কান্দিরপাড়সহ ৮টি গ্রামের নিরীহ নিরপরাধ মানুষ রাংতা গ্রামের কেতনার বিলের ধান ও পাটক্ষেতের মধ্যে আশ্রয় নেয়। স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকিস্তানী সৈন্যরা কেতনার বিলে লুকিয়ে থাকা নিরীহ গ্রামবাসীদের ওপর গুলি করতে থাকে। ওইদিন অন্তত দেড় সহস্রাধিক নিরীহ গ্রামবাসী প্রাণ হারায়। সেদিনের প্রত্যক্ষদর্শী রাজিহারের কাশীনাথ পাত্রের পুত্র অমূল্য পাত্র জানান, ওইসময় প্রাণ বাঁচাতে পালানো মানুষের ভিড়ে লাশ সৎকার বা কবর দেয়ার লোক খুঁজে পাওয়া যায়নি। তারপরেও মৃত্যুকূপ নামে খ্যাত পাত্রবাড়ির বেঁচে থাকা হরলাল পাত্র ও অমূল্য পাত্রের নেতৃত্বে হরলালের পুত্র সুশীল পাত্র, কৃষ্ণকান্ত পাত্র কেষ্ট, রাধাকান্ত পাত্রসহ কয়েকজনে পরেরদিন তাদের হারানো স্বজনসহ প্রায় দেড়শতাধিক লোকের লাশ এনে তাদের পাত্রবাড়ির কয়েকটি স্থানে বড় বড় গর্ত করে একত্রে মাটি চাঁপা দিয়ে রাখে। গর্তের সংখ্যা ছিল ৬টি। বাকি লাশগুলো কেতনার বিলে শেয়াল, কুকুরের খাবার হয়ে যায়। বিলের জলে ডুবে থাকা বেশীরভাগ লাশ পচে গলে পরে থাকে বিলের মধ্যেই। শেয়াল, কুকুওে খেয়ে ওইসব লাশের গন্ধ ছড়াতো। কাশীনাথ পাত্রের আরেক পুত্র জগদীশ পাত্র জানান, জীবন বাঁচাতে তার বাবা সেদিন পালাতে চেয়েও পারেননি। তার বাবার গায়ে ৫টি গুলি লেগেছিল। একই সাথে স্থানীয় রাজাকাররা লাশের শরীর থেকে হাতিয়ে নেয় মূল্যবান স্বর্ণালঙ্কার ও টাকা পয়সা।
নিহত হয়েছেন যারা : কেতনার বিলের গণহত্যায় একমাত্র রাজিহারের পাত্রবাড়ির কাশীনাথ পাত্র, বিনোদ পাত্র, বিনোদের স্ত্রী সোনেকা পাত্র, মেয়ে গীতা পাত্র, কানন পাত্র, মঙ্গল পাত্র, মঙ্গলের মা হরিদাসী পাত্র, মেয়ে অঞ্জলি পাত্র, দেবু পাত্রের স্ত্রী গীতা পাত্র, মোহন পাত্র, মেয়ে ক্ষেতি পাত্র, কার্তিক পাত্রের স্ত্রী শ্যামলী পাত্র, তার ১২দিনের শিশু অমৃত পাত্র, মেয়ে মঞ্জু পাত্র, মতিলাল পাত্র, লক্ষ্মীকান্তের স্ত্রী সুমালা পাত্র, নিবারণ বিশ্বাসসহ একই বাড়ির ১৯জন প্রাণ হারিয়েছিলেন। এরমধ্যে ১২দিনের শিশু অমৃতকে পাকহানাদাররা পায়ের বুটে পিষ্ঠ করে ও নিবারণকে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে।
ক্ষোভ প্রকাশ: শহীদদের স্বজন ধীরেন পাত্র, জগদীশ পাত্রসহ অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, তাদের স্বজনরা ওইদিন পাকসেনাদের গুলিতে শহীদ হলেও আজ পর্যন্ত তাদের পরিবারকে শহীদ পরিবার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। এছাড়া ওইসব শহীদের স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণে এখনও কেতনার বিলে নির্মিত হয়নি কোন স্মৃতিসৌধ। কেতনার বিলে পাকহানাদার বাহিনীর নির্মম বুলেটে শহীদ হওয়া ৫শতাধিক শহীদের স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণের জন্য শহীদ পরিবারসহ স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা, বিভিন্ন পর্যায়ের জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিক ও সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উর্ধতন কর্মকর্তাদের কাছে জোর দাবি করেছেন।
Discussion about this post