দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ২৩ মে: মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িতদের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এ পর্যন্ত ১৮ মামলায় ২০ আসামির বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করেছে। আরো ১ মামলার রায় ঘোষণা অপেক্ষমান রয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রাজাকার পলাতক সৈয়দ মোঃ হাসান আলী ওরফে হাছেন আলীর বিরুদ্ধে মামলায় গত ২০ এপ্রিল যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে রায় ঘোষণা অপেক্ষমান রাখা হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল-১এর চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল এ আদেশ দেয়।
পৃথক দু’টি ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত ১৮ মামলায় ২০ আসামির বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করা হয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের রাজাকার মাহিদুর রহমান ও আফসার হোসেন চুটুকে মানবতাবিরোধী অপরাধে আমৃত্যু কারাদন্ড দিয়ে গত ২০ মে ঘোষিত রায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ১৮তম রায়। ট্রাইব্যুনাল-২এর চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল এ রায় দেয়।
২০১৩ সালের ২১ জানুয়ারি প্রথম রায়ে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক রুকন আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসির আদেশ দিয়ে প্রথম রায় ঘোষণা করা হয়। পলাতক থাকায় তিনি আপিলের সুযোগ পাননি। এর পর একই বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় রায়ে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়া হয়। আপিলে গত বছর ১৭ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগ এ মামলার চূড়ান্ত রায়ে কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদন্ড দেয়। যা ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর কার্যকর করা হয়।
ট্রাইব্যুনালের তৃতীয় রায়ে গত বছর ২৮ ফেব্রুয়ারি জামায়াতের নায়েবে আমীর দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির আদেশ হয়। ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের রায়ে গত ১৭ সেপ্টেম্বর তার সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদন্ডের আদেশ দেয় আপিল বিভাগ। গত বছর ৯ মে চতুর্থ রায়ে জামায়াতের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদন্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিলেও কামারুজ্জামানকে ট্রাইব্যুনালের মৃত্যুদন্ডের রায় বহাল রেখে রায় দেয় সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ। গত ১১ এপ্রিল কামারুজ্জামানের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়।
পঞ্চম রায়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন জামায়াতের আমীর গোলাম আযমকে গত বছর ১৫ জুন ৯০ বছরের কারাদন্ড দেয়া হয়। রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের শুনানি অপেক্ষমান থাকাবস্থায় গতবছর ২৩ অক্টোবর কারা হেফাজতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় তার। ইতোমধ্যে তার আপিলটি অকার্যকর ঘোষণা করা হয়েছে। গত বছর ১৭ জুলাই ষষ্ঠ রায়ে জামায়াতের বর্তমান সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। এ রায়ের বিরুদ্ধে আনা আপিলের ওপর সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে শুনানি অব্যাহত রয়েছে।
গত বছর ১ অক্টোবর সপ্তম রায়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর ফাঁসির রায় হয়। এ রায়ের বিরুদ্ধে দায়ের করা আপিলও শুনানির জন্য অপেক্ষমান রয়েছে। গতবছর ৯ অক্টোবর বিএনপির সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীমকে আমৃত্যু কারাদন্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। দন্ড ভোগ করা অবস্থায় ৮৩ বছর বয়সে গত ৩০ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন তিনি। বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে ৭১’ এর দুই আল-বদর নেতা আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মঈনুদ্দীনকে গতবছর ৩ নভেম্বর মৃত্যুদন্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। তারা দুজনেই পলাতক রয়েছেন। ফলে তারা আপিলের সুযোগ পাননি।
দশম রায়ে গত ২৯ অক্টোবর জামায়াতের বর্তমান আমীর মতিউর রহমান নিজামীকে মৃত্যুদন্ড দিয়ে রায় ঘোষণা করা হয়। এ রায়ের বিরুদ্ধে আসামিপক্ষে আপিল করা হয়েছে। একাদশ রায়ে গতবছর ২ নভেম্বর জামায়াতের নির্বাহী পরিষদ সদস্য মীর কাসেম আলীকে মৃত্যুদন্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়েছে।
গত ১৩ নভেম্বর ঘোষিত ফরিদপুরের নগরকান্দা পৌরসভার মেয়র ও বিএনপি নেতা পলাতক জাহিদ হোসেন ওরুফে খোকন রাজাকারকে মৃত্যুদন্ড রায় দেয় ট্রাইব্যুনাল। এটি ছিলো দ্বাদশ রায়। ব্রাহ্মনবাড়িয়ার মোবারক হোসেনকে মৃত্যুদন্ড দিয়ে গত ২৪ নভেম্বর ঘোষিত রায় ট্রাইব্যুনালে দেয়া ১৩তম রায়। এ রায়ের বিরুদ্ধে আসামিপক্ষ আপিল দায়ের করেছে। সাবেক প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারকে মৃত্যুদন্ড দিয়ে গত ২৩ ডিসেম্বর টাইব্যুনাল ১৪ তম রায় ঘোষণা করেছে। এ রায়ের বিরুদ্ধে আসামিপক্ষ আপিল দায়ের করেছে।
গতবছর ৩০ ডিসেম্বর জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলামকে মৃত্যুদন্ড দিয়ে ট্রাইব্যুনাল ১৫ তম রায় ঘোষণা করে। এ রায়ের বিরুদ্ধে আসামিপক্ষ আপিল দায়ের করেছে। জামায়াতের নায়েবে আমীর আব্দুস সুবহানকে মৃত্যুদন্ড দিয়ে গত ১৮ফেব্রুয়ারি ঘোষিত রায় ট্রাইব্যুনালের ১৬ তম রায়। এ রায়ের বিরুদ্ধে আসামিপক্ষ আপিল দায়ের করেছে। জাতীয় পার্টির নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার পলাতক ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল জব্বারকে আমৃত্যু কারাদন্ড দিয়ে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ঘোষিত রায় ট্রাইব্যুনালের ১৭ তম রায়। এ রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করেছে।
ট্রাইব্যুনালের অন্যতম প্রসিকিউটর মোখলেসুর রহমান বাদল বাসস’র সঙ্গে আলাপকালে এ কথা জানান। এ প্রসিকিউটর বলেন, আরো ২ মামলায় ৪ আসামির বিরুদ্ধে বিচার শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আসামিরা হলেন-একটি মামলায় বাগেরহাটের শেখ সিরাজুল হক ওরফে সিরাজ মাস্টার, আব্দুল লতিফ ও খান আকরাম হোসেন। অপর একটি মামলায় আসামি পটুয়াখালীর ফোরকান মল্লিক।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের অন্যতম প্রধান অঙ্গীকার ছিলো যুদ্ধপরাধীদের বিচার করা। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বধীন মহাজোট দুই তৃতীয়াংশের বেশী আসনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। সরকার গঠনের পর সংসদের প্রথম অধিবেশনেই যুদ্ধপরাধীদের বিচারে সর্বসম্মত প্রস্তাব গৃহীত হয়। এরপর ২০১০ সালের ২৫ মার্চ ট্রাইব্যুনাল, তদন্তকারী সংস্থা ও প্রসিকিউশন টিম গঠন করা হয়। প্রথমে ১টি ট্রাইব্যুনালে এ বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। পরে এ বিচারকে তরান্বিত করতে ২০১২ সালের ২২ মার্চ আরো একটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। বিচারিক কার্যক্রম শেষে ট্রাইব্যুনাল-১ এ ৮টি ও ট্রাইব্যুনাল-২ এ ১০টি মামলার রায় ঘোষণা করা হয়। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের পর নয়টি রায় হলো।
Discussion about this post