দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৫: পূর্ব দিগন্তে সূর্য উটেছে রক্ত লাল…. রক্ত লাল….। বুধবার ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস । বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে এক অনন্য গৌরবের দিন । দীর্ঘ ৯ মাসের মুক্তি যুদ্ধে লাখো রক্তের বিনিময়ে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙের এমন অনন্য ইতিহাস আর কোন জাতির নেই । যাত্রা শুরু হয় মুক্ত স্বাধীন লাল সবুজ পতাকার বাংলাদেশের । কাল প্রবাহে কেটে গেছে ৪৪ বছর । যাদের বিনিময়ে দুই যুগের পাকিস্তানি শাসনের অবসান ঘটেছিল, বিশ্বেও মানচিত্রে অভ্যূদয় ঘটেছিল বাংলাদেশ নামের নতুন এক রাষ্ট্রের , মুক্তি যুদ্ধে বাঙালির বিজয়ের সেই ৪৪ তম বার্ষিকীতে শ্রদ্ধাভরে সেই বীর সন্তানদের স্মরণ করলো জাতি ।
বুধবার ভোরে সুর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে (পুরনো বিমানবন্দর) ৩১ বার তোপধ্বনির মধ্য দিয়ে শুরু হয় বিজয় দিবসের আনুষ্ঠানিকতা।সকাল সাড়ে ৬টার পর রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাভারে জাতীয় স্মৃতসৌধে ফুল দিয়ে সেই মুক্তিসেনাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান, যারা প্রাণের বিনিময়ে ছিনিয়ে এনেছিল বাংলার স্বাধীনতার সূর্য।তিন বাহিনীর একটি চৌকস দল এ সময় সালাম জানায়। শহীদদের স্মরণে বিউগলে বাজানো হয় করুণ সুর।জাতির যে বীর সন্তানদের আত্মত্যাগে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম, কিছুটা সময় নিরবে দাঁড়িয়ে একাত্তরের সেই শহীদদের স্মরণ করেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী।
এরপর জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা স্মৃতিসৌধে ফুল দেন।আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হিসাবে দলের নেতা-কর্মীদের নিয়ে পরে আবারও শ্রদ্ধা নিবেদন করেন শেখ হাসিনা।জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের নিয়ে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ, মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, সংসদ সদস্য, বিচারপতি, তিন বাহিনীর প্রধান, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ভারতীয় সশস্ত্রবাহিনীর সদস্য ও কূটনীতিকরাও শহীদ বেদিতে ফুল দিয়ে স্মরণ করেন একাত্তরের শহীদদের। এদিকে, মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।বুধবার সকাল ১০টা ৫০ মিনিটে তিনি এ শ্রদ্ধা জানান। এর কয়েক মিনিট আগে তিনি সেখানে পৌঁছান।এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখর“ল ইসলাম আলমগীর, যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ, মাহাবুব উদ্দিন খোকন, স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান, অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়াসহ যুবদল-ছাত্রদল ও বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা।
ভিআইপিদের শ্রদ্ধা জানানোর পর জাতীয় স্মৃতিসৌধ খুলে দেয়া হয় সবার জন্য; পতাকা আর ফুল হাতে জনতার ঢল নামে সৌধ প্রাঙ্গণে। ফুলে ফুলে ভরে ওঠে শহীদের স্মৃতির মিনার।১৪ দলের পক্ষ থেকে স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব-উল-আলম হানিফ সাংবাদিকদের বলেন, একাত্তরে পাকিস্তানিরা পরাজিত হলেও তাদের দোসররা দীর্ঘদিন এ দেশে অশুভ তৎপরতা চালিয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নষ্ট করার চেষ্টা করেছে।যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না করা পর্যন্ত জাতিকে অভিশাপমুক্ত করার সুযোগ ছিলো না। শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী দের বিচারের রায় কার্যকর করে ৩০ লাখ শহীদের আত্মার অভিশাপ থেকে মুক্ত হওয়ার সুযোগ হয়েছে এখন।
যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতকেও নিষিদ্ধ করা হবে জানিয়ে শেখ হাসিনার ওপর আস্থা রাখার পরামর্শ দেন হানিফ। বুধবার জাতীয় স্মৃতিসৌধে বীর শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের ( জেএসডি) সভাপতি আ স ম আব্দুর রব। পরে তিনি সাংবাদিকদের কাছে বর্তমান নির্বাচন কমিশনকে ঠুঁটো জগন্নাথ বলে মন্তব্য করেন ।রব বলেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের কোনো ক্ষমতা নেই। এই ঠুঁটো জগন্নাথ নির্বাচন কমিশন দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।তিনি বলেন, স্বাধীনতার ৪৫ বছরেও আমরা স্বাধীন হতে পারিনি। ১৬ কোটি মানুষ যেদিন উন্নত জীবন পাবে, সেদিন স্বাধীনতার স্বাদ পাবো। তিন বেলা খেয়ে থাকা মানেই স্বাধীনতা নয়।আজ বিদেশিদের হত্যা করা হচ্ছে। শিক্ষার্থীকে নির্যাতন করা হচ্ছে। এ মুহূর্তে একা প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে দেশকে জঙ্গিবাদ মুক্ত করা সম্ভব নয়। এজন্য সবাইকে একতাবদ্ধ হতে হবে, বলেন আব্দুর রব।তিনি আরও বলেন, দেশে বহু দিবস রয়েছে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের দিবস কই? এই দৃশ্য দেখবে বলে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করিনি।বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে ১৯৭১ সালে মুক্তি সংগ্রাম শুরুর পর ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স (এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে মুক্তিবাহিনী ও ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় সেনা কমান্ডের যৌথ নেতৃত্বের কাছে আত্মসমর্পণ করেন যুদ্ধে পাকিস্তানকে নেতৃত্ব দেওয়া লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমীর আব্দুল্লাহ খান নিয়াজী।
একাত্তরে বাঙালি হত্যায় পাকিস্তানি বাহিনীর দোসরদের যারা জড়িত ছিল, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে তারা চলে যায় ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।বহু প্রতীক্ষা শেষে চার দশক পর শুরু হওয়া যুদ্ধাপরাধের বিচারের রায় আসার পর একে একে চারজনকে ঝোলানো হয় ফাঁসিতে।স্মৃৃতিসৌধের অনুষ্ঠান চলার মধ্যেই সকাল ১০টায় রাজধানীতে জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে শুরু হয় কুচকাওয়াজ। রাষ্ট্রপতি প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে কুচকাওয়াজ পরিদর্শন ও সালাম করেন। প্রধানমন্ত্রীও এ কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। মহান বিজয় দিবসে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের শ্রদ্ধা জানাতে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে জনতার ঢল নেমেছে। কুয়াশা ও ঠাণ্ডা বাতাস উপেক্ষা করে বীর শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে ভোর থেকে মহাসড়কের পাশে অপেক্ষা করতে থাকেন সর্বস্তরের মানুষ।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা জানানোর পর সর্বস্তরের মানুষের ঢল নামে জাতীয় স্মৃতিসৌধে। বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ ছুটে আসেন বীর শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে।গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিওথেরাপি বিভাগের দ্বিতীয় সেমিস্টারের শিক্ষার্থী মিজানুর রহমান শ্রদ্ধা জানাতে এসে বলেন, শীতের সকালের ঘুমটা সবারই কাছে প্রিয়। তবে তার থেকে বেশি প্রিয় বিজয়ের সকাল। স্কুল ও কলেজে শহীদ মিনারে ফুল দিতাম, আজ স্মৃতিসৌধে ফুল দিতে পেরে ভালো লাগছে।বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ক্যাপিটাল মার্কেটের (বিআইসিএম) ৩০ জন সদস্য ফুল দিতে এসেছেন স্মৃতিসৌধে। বিআইসিএম-এর কর্মকর্তা আবদুল্লাহিল ওয়ারিশ বলেন, আজকের দিনটি বাঙালি জাতির স্মরণীয় দিন, এটি একটি গৌরবের দিন। যতদিন বাঁচবো এই দিনটা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবো।জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শা স্টিফেনস ব্লুম বার্নিকাট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক।আরেফিন সিদ্দিক বলেন, বর্তমান সরকারের নেতৃত্বে দেশ আজ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এগিয়ে যাচ্ছে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু প্রকল্পের নির্মাণ কাজ প্রমাণ করে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে পাকিস্তান যে মিথ্যাচার করেছে সেজন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাদের সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করেছে।
সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের ভাইস চেয়ারম্যান আবু ওসমান চৌধুরী শ্রদ্ধা জানাতে এসে বলেন, পাকিস্তান আন্তর্জাতিকভাবে মিথ্যাচার করছে। এই মিথ্যাচারের জন্য শুধু প্রতিবাদ করলেই হবে না। তাদের সঙ্গে শিক্ষা, ব্যবসা বাণিজ্য ও সাংস্কৃতি সম্পর্কসহ সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে।সকাল সাড়ে ৮টায় বিকল্পধারার প্রেসিডেন্ট একিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী নেতা-কর্মীদের নিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এর আগে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, স্বাধীনতা মানে ভালো থাকবো, ভালো চলবো ও গণতন্ত্র। গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা যেদিন একই সঙ্গে চলবে সেদিনই প্রকৃত বিজয়ের স্বাদ পাবো। আমরা স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রকে একসঙ্গে দেখতে চাই। তবে সেদিন আর বেশি দূরে নয় স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র একসঙ্গে চলবে। বর্তমানে দেশে অসম্পূর্ণ গণতন্ত্র বিরাজ করছে।বেলা যতই গড়ায় সর্বস্তরের মানুষের ঢল ততই বাড়ে।
সকাল ১০টা পর্যন্ত স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেছে, জাকের পার্টি, ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ, জাতীয়তাবাদী যুবদল, বাংলাদেশ লোক-প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (বিপিএটিসি), জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্র (সিআরপি), শ্রমিক লীগ, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, কেন্দ্রীয় গো-প্রজনন দুগ্ধ খামার, জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরাম, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন, জাতীয়তাবাদী শ্রমিকদল, পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশন, জাতীয় পার্টি, প্রশিকা, আমরা মুক্তিযুদ্ধের সন্তান. মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, ন্যাপ, জাতীয় গার্মেন্ট শ্রমিকফেডারেশন, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন, সাম্যবাদী দলসহ আরও অনেক রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন। তবে বরাবরের মতো এবারও লাল সবুজ পতাকায় স্মৃতিসৌধে আসেন সজাগ এর পাঁচ শতাধিক কর্মী। এরা সবাই ধামরাইয়েরশৈলান গ্রাম থেকে মোটরসাইকেলযোগে আসেন। তারা শহীদ বেদীর সামনে মুষ্টিবদ্ধ হাতে শপথ করেন দেশ গড়ার।সজাগ কর্মী বাবুল সারোয়ার বলেন, প্রতিটা জাতীয় অনুষ্ঠানে আমরা এখানে আসি। দেশ গড়ার শপথ নেই যাতে করে মক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারি।
মানুষের এই মিছিলে হঠাৎ করেই নজর কাড়ে ছোট্ট এক শিশু। আফরা জাহান রাফা নামের ওই শিশুটিকে দেখে মনে হবে এক টুকরো বাংলাদেশ। মাথায় বেঁধেছে জাতীয় পতাকা। কপালের ছোট্ট টিপেও বাংলাদেশের পতাকা শোভিত। জাতীয় পতাকার লাল-সবুজ রঙে মোড়া তার সারা শরীর। হাতেও রয়েছে বড় একটি জাতীয় পতাকা।রাফার সাজপোশাক দেখে স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানাতে আসা সবাই তাকে আপন করে নেয়। শ্রদ্ধা জানাতে আসা জনতার ঢলে অনেকেই রাফার সঙ্গে ছবি তোলেন।রাজধানীর বাড্ডা থেকে বাবা আখতার হোসেনের সঙ্গে এসেছে রাফা। বিজয় দিবসটি ব্যতিক্রমভাবে উদযাপন করেন তিনি। এদিনে দুই মেয়ে ও স্ত্রীসহ পুরো পরিবার বিজয়ের সাজে রঙিন হয়ে আসেন স্মৃতিসৌধে। রাফার খালা নাসিমা খাতুন ও তার মেয়ে উমরা জাহান সোহিও এসেছে লাল-সবুজের সাজে।বিজয় দিবসে পতাকার সাজ প্রসঙ্গে আখতার হোসেন বলেন, ছয় বছর ধরে আমরা স্বপরিবারে বিজয়ের সাজে আসি স্মৃতসৌধে। পতাকা বাঙালির অস্তিত্ব। নয় মাস যুদ্ধের পরে আমরা বিজয় অর্জন করেছি। বিজয় দিবসে লাল-সবুজের সাজ আমাদের ভালো লাগে। এই পোশাকে নিজেদের বীর বাঙালি মনে হয়।
Discussion about this post