নাটকীয়তার অবসান ঘটিয়ে গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের কনডেম সেলে বন্ধি মানবতা বিরোধী অপরাধের মামলায় ফাঁসির দ-প্রাপ্ত আসামী জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলী প্রাণভিক্ষা চাইবেন না বলে কারা কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন। ফলে প্রথমবারের মতো এ কারাগারে কোনো যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির দন্ড কার্যকর হতে যাচ্ছে। তবে প্রস্তুত রাখা হয়েছে কেরানীগঞ্জের কারাগারকেও। এখন চলছে দন্ড কার্যকরের পরবর্তী কার্যক্রম। কিন্তু কখন কার্যকর হচ্ছে জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীর ফাঁসি? এমন প্রশ্ন এখন সাধারণ মানুষের মুখে মুখে। তবে আইনী প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়ায় শুক্রবার দিবাগত রাতে ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম বলে কারা সূত্রে জানা গেছে। ইতোমধ্যে যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা আল বদর বাহিনীর কমান্ডার ‘বাঙ্গালী খান’ মীর কাসেম আলীর ফাঁসির দন্ড কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে কার্যকর করতে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। প্রস্তুত রাখা হয়েছে ফাঁসির মঞ্চ ও জল্লাদ। এখন সরকারের সিদ্ধান্ত পেলেই যেকোন সময়ে মীর কাশেমের ফাঁসির দন্ড কার্যকর করা হবে। তাই কারাগার এলাকার নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে।
গাজীপুরস্থিত কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২ এর নাশির আহমেদ জানান, মানবতা বিরোধী অপরাধে ফাঁসির দ-প্রাপ্ত আসামী জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলী এ কারাগারের ৪০ নম্বর কনডেম সেলে বন্ধি রয়েছেন। আইনী লড়াইয়ের সর্বশেষ ধাপ মঙ্গলবার নিষ্পত্তি হওয়ায় মীর কাশেম আলীর ফাঁসির রায় বহাল রয়ে যায়। এরপর আদালতের দেয়া রায় কার্যকরে আইনী প্রক্রিয়ার সর্বশেষ পর্যায়ে মীর কাসেমের সামনে তার কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা প্রকাশ করে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার সুযোগ কেবল বাকি থাকে। কিন্তু শুক্রবার দুপুরের পর কারাকর্তৃপক্ষ রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার ব্যাপারে তৃতীয়বারের মত মীর কাসেমের কাছে সিদ্ধান্ত জানতে চায়। এসময় তিনি প্রাণভিক্ষা চাইবেন না বলে জানিয়ে দেন কারা কর্তৃপক্ষকে। বিষয়টি নিষ্পত্তির ফলে মীর কাশেমের সকল নাটকীয়তার অবসান ঘটেছে। এখন চলছে দন্ড কার্যকরের আইনী প্রক্রিয়া। এর আগে গত বুধবার ও বৃহস্পতিবার তার কাছে প্রাণভিক্ষার ব্যাপারে জানতে চাইলে মীর কাশেম ভেবেচিন্তে জানানোর কথা বলে কারা কর্তৃপক্ষের কাছে সময় চান। মীর কাশেম আলী সুস্থ্য আছেন। কারাগারের চিকিৎসকরা তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেছেন। তাকে স্বাভাবিক খাবার দেয়া হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কারা অধিদফতরের একাধিক দায়িত্বশীল শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, দন্ডপ্রাপ্ত মীর কাশেম আলীর ফাঁসির রায় আজ (শুক্রবার দিবাগত) রাতে কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। প্রাণভিক্ষার আবেদন না করলেও ফাঁসি কার্যকর করার আগে প্রচলিত কারাবিধি অনুযায়ী কিছু নিয়ম কানুন পালন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কারন প্রাণভিক্ষা চাওয়া না চাওয়ার বিষয়টির নিষ্পত্তি হলে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে তা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে ফাঁসির আদেশ কার্যকর করার আদেশ চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়। ওই চিঠির উত্তর হাতে পাওয়ার পর থেকে যে কোন সময়ে ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সেই নিয়ম-কানুন পালন করার মতো পর্যাপ্ত সময় আজ হাতে নেই। তাই আজ রাতে (শুক্রবার দিবাগত) রায় কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ বলে মন্তব্য করেন তারা।
এদিকে রাষ্ট্রপতির কাছে মীর কাশেম আলী প্রাণভিক্ষা না চাওয়ার সিদ্ধান্ত জানানোর পরপরই পুরো কারা ক্যাম্পাস ও আশেপাশের এলাকার নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। সংবাদ কর্মীরাও কারা এলাকায় ভীড় জমাতে শুরু করেন। কারা কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে প্রাণভিক্ষা না চাওয়ার খবর গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে রাজধানীসহ সারাদেশের মানুষ এখন উৎসুক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে গাজীপুরের এ কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের দিকে। সবার মনে শুধু একটাই প্রশ্ন-কখন হচ্ছে এই আলবদর নেতার ফাঁসি।
কারাসূত্র জানায়, অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সমন্বয়ে নিরাপত্তা বেষ্টিত গাজীপুরস্থিত কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২তে প্রথমবারের মতো কোনো যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির দন্ড কার্যকর হতে যাচ্ছে। তাই কারাগারে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। এ কারাগারে ফাঁসির মঞ্চ একটি আছে। ইতোমধ্যেই ধোয়া মোছা করে মঞ্চটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে। ফাঁসির জন্য বিশেষ ভাবে তৈরী মোম মাখানো রশিতে বালুর বস্তা দিয়ে প্রাথমিক মহড়া সম্পন্ন করা হয়েছে। প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে জল্লাদ শাহজাহান, রাজু, পল্টুসহ কয়েকজনকে। এই জল্লাদ দল ইতোপূর্বে যুদ্ধাপরাধের মামলায় দন্ডিত আসামি মতিউর রহমান নিজামী, কাদের মোল্লা, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসি কার্যকর করেছিল। গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের কাশিমপুর এলাকার বিশাল এ কারা ক্যাম্পাসে হাইসিকিউরিটি ও মহিলা কারাগারসহ মোট ৪টি কারাগার রয়েছে।
সূত্র আরও জানায়, কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২ দেশের ৬৮টি কারাগারের মধ্যে একটি ব্যতিক্রমী ও আধুনিক সুযোগ সুবিধা সম্পন্ন কারাগার। সেখানে বন্দিদের থাকার জন্য রয়েছে ৬তলা বিশিষ্ট ৬টি ভবন। প্রতিটি ফ্লোরে রয়েছে ২১টি করে ওয়ার্ড। এই কারাগারে ফাঁসির আসামিদের জন্য আছে ৪০টি কনডেম সেল, যার একটিতে রয়েছেন মীর কাসেম আলী।
উল্লেখ্য, একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ২০১২ সালের ১৭ জুন মতিঝিলের নয়া দিগন্ত কার্যালয় হতে মীর কাসেম আলীকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি ১৯৮৫ সাল থেকে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ অর্থাৎ মজলিসে শুরার সদস্য হিসেবে দলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছিলেন। ২০১২ সালে গ্রেফতারের পরের বছর ৫ সেপ্টেম্বর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে ট্রাইব্যুনালে তার যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হয়। ২০১৪ সালের ২ নবেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে মীর কাসেম আলীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকরের রায় দেয়। রায় ঘোষণার আগে হাজতবাসকালে তিনি ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দির মর্যাদায় ছিলেন। পরে দন্ডপ্রাপ্তির পর তাকে ফাঁসির (কনডেম) সেলে পাঠানো হয়।
প্রসঙ্গতঃ মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে মীর কাসেম আলীকে ২০১৪ সালের ২ নবেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকরের রায় দেয়। একই বছরের ৩০ নবেম্বর ট্রাইব্যুনালের মৃত্যুদন্ডের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেন এই আলবদর কমান্ডার। চলতি বছরের (২০১৬) ৮ মার্চ দেওয়া রায়ে আপিল বিভাগও তার মৃত্যুদন্ড বহাল রাখে। গত ১৯ জুন ফাঁসির রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে আবেদন করেন মীর কাসেম আলী। মঙ্গলবার প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বেঞ্চ যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলীর ফাঁসির রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন খারিজ করে মৃত্যুদন্ড বহাল রাখেন। এতে তার আইনী লড়াই শেষ হয়েছে। রিভিউয়ের পূর্ণাঙ্গ রায়ের প্রত্যায়িত অনুলিপি বিচারিক আদালত আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়ে রাত ১২ টা ৪৮ মিনিটে কাশিমপুরের কারাগারে পৌছে। পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও দুই পক্ষের আইনজীবীকেও অনুলিপি পাঠানো হয়। এরপর বুধবার সকালে কারা কর্তৃপক্ষ আসামি কাসেমকে রিভিউ খারিজের রায় ও আদেশ পড়ে শুনিয়ে জানতে চান- তিনি প্রাণভিক্ষা চাইবেন কি না। এসময় মীর কাশেম তার সিদ্ধান্ত জানানোর ব্যাপারে কারা কর্তৃপক্ষের কাছে সময় চান। বৃহষ্পতিবারও তার কাছে সিদ্ধান্ত জানতে চাইলে একই জবাব দেন তিনি। এপর শুক্রবার দুপুরের পর তৃতীয়বারের মতো মীর কাসেমের কাছে সিদ্ধান্ত জানতে চায় কারা কর্তৃপক্ষ। এসময় তিনি প্রাণভিক্ষা চাইবেন না বলে জানিয়ে দেন কারা কর্তৃপক্ষকে। ফলে বিষয়টির নিষ্পত্তি হয়। এরপরই সরকার দন্ড কার্যকরের পরবর্তী আইনী প্রক্রিয়া শুরু করে।
১৯৫২ সালের ৩১ ডিসেম্বর মীর কাসেম আলীর জন্ম মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার চালা গ্রামে। ডাকনাম পিয়ারু ওরফে মিন্টু। বাবার চাকরির সুবাদে চট্টগ্রামে থাকতেন ছোটবেলায়। সেখানে জড়িত হন ইসলামী ছাত্রসংঘের রাজনীতিতে। ১৯৭১ সালের ৭ নবেম্বর পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সাধারণ সম্পাদক হন তিনি। ১৯৭৭ সালে নাম বদল করে তার নেতৃত্বে ইসলামী ছাত্রশিবির হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এ সংগঠনটি। তিনি হন প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। পরবর্তীতে যোগ দেন জামায়াতে ইসলামীতে। একাত্তরে চট্টগ্রামে অবস্থানের সময় ঘাতক আলবদর বাহিনীর ক্যাম্প ও টর্চার সেল স্থাপন করেন ডালিম হোটেল নামে পরিচিত স্থানীয় মহামায়া হোটেলে। সেখানে নির্যাতন ও হত্যা করা হয়েছে স্বাধীনতার বহু সমর্থককে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ডালিম হোটেল চট্রগ্রামবাসীর কাছে হত্যাপুরী হিসেবে পরিচিতি পায়। নৃশংসতার জন্য মীর কাশেমের পরিচয় হয় ‘বাঙালি খান’। ছাত্রসংঘের বাছাই করা কর্মীদের সমন্বয়ে গঠিত কুখ্যাত আলবদর বাহিনীর তিনি ছিলেন তৃতীয় কমান্ডার।
এই গুপ্ত ঘাতক বাহিনীতে নেতৃত্ব ও প্রভাব বিবেচনায় ছিল জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামী ও সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের পর জামায়াতের পঞ্চম শীর্ষ নেতা এবং একই সাথে আলবদর বাহিনীর তৃতীয় প্রধান নেতা। আর বিশেষভাবে তিনি ছিলেন চট্রগ্রাম অঞ্চলে এই বাহিনীর প্রধান। স্বাধীনতার পর জামায়াতে ইসলামীকে আর্থিকভাবে শক্তিশালী করতে কাজ করেন তিনি। ১৯৮০ সালে তিনি মধ্যপ্রাচ্য ভিত্তিক এনজিও রাবেতা আল আলম আল ইসলামীর এ-দেশীয় পরিচালক হন। তিনি ১৯৮৫ সাল থেকে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ অর্থাৎ মজলিসে শুরার সদস্য হিসেবে দলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছিলেন।
ইবনে সিনা ট্রাস্টসহ বহু আর্থিক, বাণিজ্যিক ও চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা পরিচালক মীর কাসেম আলী দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশনের চেয়ারম্যান। বিগত তিন দশকে তিনি জামায়াতে ইসলামীর প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য অর্থের অন্যতম জোগানদাতায় পরিণত হন। অর্থাৎ তার যোগানো অর্থেই জামায়াতে ইসলামী শক্ত ভিত্তি পায়।
মোস্তাফিজুর রহমান টিটু, স্টাফ রিপোর্টার, গাজীপুর।
Discussion about this post