বঙ্গবন্ধুকে কে হত্যা করেছে? বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায়ে ১২ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ হয়েছে। রায় অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে পাচঁজনের। প্রকৃত খুনি কি এই পাঁচজনের মধ্যেই কেউ, নাকি পলাতক ৬ জনের কেউ? নাকি জিম্বাবুয়েতে মৃত্যুবরণকারী আজিজ পাশা?
ফৌজদারি কার্যবিধি, দণ্ডবিধির হিসেব নিকেশে এই ১২ জনই যৌথভাবে দায়ী। কার কতটুকু দায় সেটি ঘটনার প্রশ্ন। কিন্তু খুন হওয়া ব্যক্তিটি যখন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু , তখন ইতিহাসের প্রশ্ন থেকে যায়: কে সেই খুনি যে পিতার বুকে গুলি চালাল?
এ বিষয়ে একাধিক ইঙ্গিত রয়েছে। আদালতের রায়েও উঠে এসেছে সে মর্মান্তিক ঘটনার বর্ণনা। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ওপর প্রথম যে বইটি আমি পড়ি (১৯৯৮ সালে) সেটি হলো, ‘Bangladesh: A Legacy of Blood’. অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাসের সেই বই থেকে খুনি-ষড়যন্ত্রকারীদের পরিচয় জানা যায়। পরে আরো অনেক বই হাতে এসেছে।
ম্যাসকারেনহাসের ভাষ্যমতে, মেজর মহিউদ্দিন, হুদা ও নূর বাড়ির প্রতিটি কামরা মুজিবের খেঁাজে তন্নতন্ন করে চষে বেড়িয়েছে। হঠাৎ মহিউদ্দিন মুজিবকে পেয়ে যায়। কিন্তু মহিউদ্দিন শেখ মুজিবের সামনে দাঁড়িয়ে তার বিশাল ব্যক্তিত্বের কাছে পুরোপুরি মনোবল হারিয়ে ফেলে। হুদা-মোসমেল-ফারুকের ভাষ্যমতে, সেসময় নূর যদি না থাকতো তবে ঘটনা অন্যরকম হতো।
বঙ্গবন্ধু বলেন, তোরা কি চাস? তোরা কি আমাকে খুন করতে চাস? পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তা করতে পারেনি। তোরা কি মনে করিস তা করতে পারবি? এভাবে আরো কিছুক্ষণ কথা হচ্ছিল বঙ্গবন্ধু ও মহিউদ্দিনের আর তাতেই মহিউদ্দিন পুরোপুরি নতজানু হয়ে পড়ছিল।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড নিয়ে তথ্য ও ইতিহাসনির্ভর যে কয়েকটি বই আমরা পেয়েছি সেসবের মধ্যে ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেনের ‘বাংলাদেশ: রক্তাক্ত অধ্যায়-১৯৭৫-৮১’ অন্যতম। লেখক তখন ঢাকার ৪৬ ব্রিগেডের স্টাফ অফিসার ছিলেন। হত্যাকাণ্ড-পরবর্তী ঘটনাক্রমের তিনি প্রত্যক্ষদর্শীও। তার বইতেও নূরই বঙ্গবন্ধুর খুনি।
এছাড়া বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পূর্বাপর ঘটনার ওপরে লিখেছেন ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের তৎকালীন স্টেশন কমান্ডার লে: কর্নেল (অব) এম.এ হামিদ। তার বই, ‘তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা’য় অবশ্য কয়েকটি মতামত পাই। হুদার সাথে লেখকের কথোপকথনের (হত্যাকাণ্ডের পর) বরাত দিয়ে লেখক বলেন, শেখ মুজিবের সাথে মহিউদ্দিনের নয়, মূলত হুদার কথোপথন হয়েছে। মহিউদ্দিন এসময় হুদার সাথে ছিল। আর মুজিবকে নূর গুলি করেনি, গুলি করেছে আর্মার্ড কোরের সৈনিকরা। তবে হুদার বর্ণনা অনেকেই গ্রহণ করেননি। তারা মনে করেন নূরই সেই খুনি। কারণ, মেজর ফারুকের ভাষ্যমতে শেখ মুজিবের বাড়িতে আক্রমণকালে কমান্ডার ছিল মহিউদ্দিন, হুদা নয়। আর মহিউদ্দিন ফারুককে বলেছে যে, নূরই বঙ্গবন্ধুকে গুলি করেছে।
শুধু তাই নয়, নূর নিজেই বলেছে, ‘আমিই শেখকে হত্যা করেছি’। হত্যাকাণ্ডের পর বঙ্গভবনে অনেকেই তাকে একথা বলতে শুনেছেন। এম.এ হামিদের বইয়ে লে: কর্নেল এম.এ মান্নান ও মহিউদ্দিনের কথোপকথন থেকেও জানতে পারি নূরই সেই খুনি। পরবর্তীকালে মেজর ফারুকের ভাষ্যমতে, মহিউদ্দিন ছিল আক্রমণকারী গ্রুপের কমান্ডার। ঘটনার পরপরই মহিউদ্দিন তাকে (ফারুককে) রিপোর্ট দেয় যে, নূর শেখকে হত্যা করেছে। সাংবাদিক সুখরঞ্জন দাসগুপ্ত তার ‘মুজিব হত্যার ষড়যন্ত্র’ বইতে যদিও কারো নামই নেননি, শুধু বলেছেন বঙ্গবন্ধুকে পেছন থেকে গুলি করা হয়েছে। তবে হুদা বা মোসলেম উদ্দিন যে গুলি করেননি তা তিনি বলেছেন। বাকি থাকে নূর।
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার চার নম্বর সাক্ষী হাবিলদার কুদ্দুস। তার বয়ানে ক্যাপ্টেন হুদা ও মেজর নূর স্টেনগান দিয় বঙ্গবন্ধুকে গুলি করে। তবে হুদা নিজে কখনো সে দাবি করেছে, এমন শোনা যায়নি। কিন্তু নূর সেই দাবিটাই করেছে এবং বেশিরভাগ আসামিই তা নাকচ করেনি। গেল শতকের ষাটের দশকে পাকিস্তান অবজারভারের উপ-সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়ে ঢাকায় আসেন এ.এল. খতিব। সেই থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান অবজারভার (পরে বাংলাদেশ অবজারভার) ও মর্নিং নিউজ-এ কাজ করেন। তার বই ‘হু কিল্ড মুজিব’বইটিতে অবশ্য তিনি নির্দিষ্ট করে কারো নাম বলেননি।
মেজর রফিকুল ইসলাম ‘পঁচাত্তরের রক্তক্ষণ’ বইতেও নূরকেই দায়ী করেছেন। বঙ্গবন্ধুর বুকে ২৯টি গুলি লেগেছিল। নূর বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর হুদা সৈনিকদের আদেশ দেয়, ‘তোমরা সাক্ষী রেখ না, সবাইকে শেষ করে দাও’। আনু মাহমুদ সম্পাদিত ‘বঙ্গবন্ধু হত্যার রায়:জাতির কলঙ্কমোচন’গ্রন্থেও বেশিরভাগ লেখকই মনে করেন নূরই সেই খুনি।
ফিরে আসি ম্যাসকারেনহাসে। তার কথাগুলো এরকম:
‘এমন সময়(মুজিব ও মহিউদ্দিনের কথোপকথনের সময়) নূর এসে পড়ে। তার হাতে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। মহিউদ্দিনকে একপাশে সরিয়ে দিয়ে নূর চিৎকার করে আবোল তালো বকতে বকতে তার স্টেনগান থেকে মুজিবের প্রতি ব্রাশ ফায়ার করে। স্টেনগানের গুলি তার বুকের ডান দিকে একটা ছিদ্র করে বেরিয়ে গেল। তারপর নিস্তেজ হয়ে তার দেহ মুখ থুবড়ে সিঁড়ির মাথায় পড়ে গেল। বাঙালি জাতীয়তাবাদের মহান নেতার প্রাণহীন দেহ সিঁড়ি দিয়ে কিছুদূর গড়িয়ে গিয়ে থেমে গেল। সময় তখন ৫টা ৪০ মিনিট’। রাতের সব অন্ধকার দূর করে ভোরের আলো সবে জাগবে। তখনই জাতির জীবনে আলো জ্বালিয়ে দেয়া সেই প্রদীপটি নিভিয়ে দিয়েছিল একজন–নূর চৌধুরী। তার বিচার না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার পূর্ণতা পায় কী করে? ন্যায়বিচারের জন্যই প্রয়োজন এই সমর্পণ।
Discussion about this post