জামায়াতে ইসলামীর নতুন আমির মকবুল আহমাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রাথমিক তদন্তের অগ্রগতি রয়েছে। তিনি রাজাকার ছিলেন, এটি সুস্পষ্ট। আজ সোমবার ধানমন্ডির আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তদন্ত সংস্থার কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক আবদুল হান্নান খান সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন। জামায়াতে ইসলামীর নতুন আমির মকবুল হোসেনের বিরুদ্ধে একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগের প্রাথমিক তদন্তে অগ্রগতি হয়েছে বলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক আবদুল হান্নান খান জানিয়েছেন।
হান্নান বলেন, ফেনীর মকবুল হোসেন রাজাকার ছিল তা স্পষ্ট। কিন্তু আমাদের কাছে কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল না। তবে একটি অনলাইন পত্রিকায় কয়েকদিন আগে দুটি অভিযোগ স্পেসিফিকভাবে তুলে ধরে প্রতিবেদন বের হলে আমরা গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টির তদন্ত শুরু করি।প্রাথমিক তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। কাজ চলছে, অগ্রগতিও আছে।জামায়াতের সাবেক আমির যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির পাঁচ মাস পর ছয় বছর ধরে ভারপ্রাপ্ত আমিরের দায়িত্ব পালনকারী মকবুল আহমাদ গত অক্টোবরে নতুন আমিরের দায়িত্ব পান।
এর মধ্যে সারা দেশে যুদ্ধাপরাধী ও গণহত্যার ঘটনার তালিকা প্রণয়নের সরকারি আদেশে ২০১৫ সালে দাগনভূঁইয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকতার কার্যালয় থেকে পাঠানো প্রতিবেদনে সিলোনিয়া লালপুর গ্রামের পাল বাড়ির ১০ জনকে ধরে নিয়ে হত্যা এবং এর নির্দেশদাতা হিসেবে মকবুল আহমাদের নাম উঠে আসে।অভিযোগ তদন্তে প্রথম গত ৮ নভেম্বর তদন্ত সংস্থার সহকারী পরিচালক নুরুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি দল মঙ্গলবার ফেনীর দাগনভূঁইয়া উপজেলার জায়লস্কর ইউনিয়নের সিলোনিয়া লালপুর গ্রামের পাল বাড়িতে যায়।ওই প্রতিবেদন ধরে ট্রাইব্যুনাল যুদ্ধাপরাধ সংশ্লিষ্টতার তদন্ত করছে জানিয়ে নুরুল ইসলাম বলেন, তারা পালবাড়ি পরিদর্শন ও নিহত ব্যক্তির স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেছেন। ঘটনাগুলো লিপিবদ্ধ করেছেন। সে অনুযায়ী একটি প্রতিবেদন আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে জমা দেওয়া হবে।ওই হত্যাকান্ডের সঙ্গে কারা জড়িত, কাদের নির্দেশে এ ঘটনা ঘটেছে তা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হবে।মকবুল আমির নির্বাচিত হওয়ার পর তার যুদ্ধাপরাধের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ সামনে এলে তা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে করা হচ্ছে বলে অভিযোগ তোলে তার দল।
এ বিষয়ে দাগনভূঁইয়া উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার শরীয়ত উল্যাহ বাঙ্গালি বলেন, তৎকালীন শান্তি কমিটির নেতা ও বর্তমান জামায়াতের আমির মকবুল আহমাদের নির্দেশে আল বদররা হিন্দুপাড়ায় আগুন দিয়ে ১০ জনকে হত্যা করে। এ সময় একই এলাকার খুশিপুর গ্রামের আহসানউল্যাহ নামে এক মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে লাশ সিলোনিয়া নদীতে ফেলে দেওয়া হয়।
সোমবার সংবাদ সম্মেলনে তদন্ত সংস্থার প্রধান বলেন, তদন্ত শেষে অভিযোগ প্রমাণের জন্য সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া গেলে রাজাকার মকবুলের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে মামলা করা হবে।জামায়াত আমির যে রাজাকার ছিলেন তা কিসের ভিত্তিতে নিশ্চিত হয়েছেন জানতে চাইলে হান্নান বলেন, সারা দেশের রাজাকারের তালিকা আমাদের কাছে রয়েছে।আবদুল হান্নান খান বলেন, সম্প্রতি একটি গণমাধ্যমে মকবুল আহমাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের খবর প্রকাশিত হয়। এ খবরকে গুরুত্বসহকারে নিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তদন্ত সংস্থা প্রাথমিক তদন্ত শুরু করে। ইতিমধ্যে সেই তদন্তের বেশ অগ্রগতি হয়েছে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলেই তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হবে।মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা থানার তিনজনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত চূড়ান্ত করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তদন্ত সংস্থা। এই তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
যাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত চূড়ান্ত করা হয়েছে, তাঁরা হলেন আবদুল আজিজ ওরফে হাবলু (৬৪), মোহাম্মদ আবদুল মতিন (৬৩) ও আবদুল মান্নান ওরফে মনাই (৬৪)। তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক আবদুল হান্নান বলেন, মুক্তিযুদ্ধকালে এই তিনজন মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা থানার বিভিন্ন এলাকায় অপহরণ, নির্যাতন, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, হত্যা ও গণহত্যা করেন বলে তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। এই তিনজনের বিরুদ্ধে পাঁচটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনা হয়েছে।
অভিযোগগুলো হলো:
১. ১৯৭১ সালের ১৯ মে মৌলভীবাজার বড়লেখা থানার ঘোলসা গ্রাম থেকে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) নেতা হরেন্দ্রলাল দাস, মতিলাল দাস, নগেন্দ্র কুমার দাস ও শ্রী নিবাস দাসকে অপহরণ করে আসামিরা। পরে হরেন্দ্রলাল, মতিলাল ও নগেন্দ্রকে হত্যা করা হয়।
২. বড়লেখার বিওসি কেসরিগুল গ্রাম থেকে সুফিয়া খাতুন ও আবদুল খালেককে অপহরণ করে। পরে সুফিয়া খাতুনকে পালাক্রমে ধর্ষণও করে আসামিরা।
৩. বড়লেখা থানার পাখিয়ালা গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা মইন কমান্ডারের বাড়িতে লুটপাট। তাঁর বাবা বশিরউদ্দিন, চাচা নেসার আলী, ভাই আইয়ূব আলী, ভাতিজা হারিস আলীকে অপহরণ করে রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন চালায় আসামিরা।
৪. বড়লেখার হেনাই নগর গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা মস্তকিম কমান্ডারের বাড়িতে হামলা করে। তাঁকে না পেয়ে তাঁর ভাই মতসিম আলীকে অপহরণ করে নির্যাতন করে। নির্যাতনে তাঁর পা ভেঙে যায়। তারপর বাড়িতে আগুনও ধরিয়ে দেয়।
৫. বড়লেখার দিমাই বাজার থেকে মুক্তিযোদ্ধা মনির আলীকে আটক করে। আসামিরা মনির আলী ও তাঁর স্ত্রী আফিয়া বেগমকে অপহরণ করে রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে জোড়পূর্বক ধর্ষণ করে।সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, আসামি আবদুল আজিজ ও আবদুল মান্নান গত ২ মার্চ গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন। পলাতক আছেন আবদুল মতিন। ২০১৪ সালের ১৬ অক্টোবর এই তিনজনের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়। মামলাটির তদন্ত করেছেন তদন্ত সংস্থার সহকারী পরিচালক শাহ জাহান কবির। সাক্ষী করা হয়েছে ৪০ জনকে। আবদুল হান্নান খান বলেন, এই চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে আজই জমা দেওয়া হবে।আবদুল আজিজ বর্তমানে স্থানীয় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। আবদুল মতিন জামায়াত ইসলামের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত আছেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আবদুল মান্নান ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতা ছিলেন।
Discussion about this post