সেদিনও বেতনা নদীতে স্রোত ছিল না। অথচ রক্তস্রোত বইয়ে দেওয়ার জন্য পাকিস্তানিরা বেছে নিল বেতনার তীরকেই। ভৈরবের শাখা নদী হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের আট নম্বর সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত এ নদীর উৎপত্তি মহেশপুরেই। তবে সাপের মতো এঁকেবেঁকে তা বেঁধে রেখেছে দুই বাংলার প্রাণ। সুন্দরবন ভেদ করে বঙ্গোপসাগরে অবগাহন করার আগে নাম বদলেছে কয়েকবার। ১৯২৫ সালের দিকে জমিদারি বন্দোবস্তের বলি এ নদীটি একাত্তরে হয়ে উঠেছিল মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ষাবর্ম।
ঝিনাইদহের একমাত্র সীমান্ত উপজেলা মহেশপুরের যাদবপুর যুদ্ধ ছিল কঠিন এক সম্মুখযুদ্ধ। বৃষ্টিপাত বেশি হওয়ায় বেতনা তখন পানিতে ভরপুর। যেন বর্ষাকাল। ২২ সেপ্টেম্বর, নদীতীরবর্তী গ্রাম যাদবপুর। দক্ষিণে তিন কিলোমিটারের মতো এগোলেই ভারতের সীমান্তবর্তী গ্রাম মধুপুর। এপারে গোপালপুর। পূর্বে ধান্যবাড়িয়া। মহেশপুর দিয়ে সর্পিল চক্রে ভারতের বনগাঁয় ঢুকেছে বেতনা। যাদবপুর থেকে চার কিলোমিটার দূরে চৌগাছার সুখপুকুরিয়া ইউনিয়নের বর্নি বিওপি (বর্ডার অবজারভেশন পোস্ট)। সেসময় তা ছিল পাকিস্তানি সেনাদের বড় এক ক্যাম্প।
এই বেতনা নদীর কিনার দিয়েই বর্নির পথ। এপথ ধরেই বয়রা সাব-সেক্টরের অধীন যাদবপুরের বিওপি ক্যাম্পে আসতো পাকিস্তানিরা। নদীতে তখন অনেক পানি ছিল। আর এ এলাকা ছিলো জঙ্গলাকীর্ণ। বড় বড় গাছ ছিলো। বিশেষ করে কাঁঠাল, বট ও তাল।
স্বাধীনতার ঘোষণার পর ২৮ মার্চ প্রথম যাদবপুর বিওপি ক্যাম্পে একটি ঘটনা ঘটে। তাতে বেজে ওঠে যুদ্ধের দামামা। এদিন সকালে বাঙালি ইপিআর সদস্য ও স্থানীয় মুক্তিকামী মানুষ পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা তোলেন। পরে চুয়াডাঙ্গা থেকে আসা পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন সাদিক সে পতাকা নামাতে গেলে বাইরে থেকে ‘জয়বাংলা’ স্লোগান দিতে থাকে জনগণ। তখন সাদিক রিভলবার বের করে গুলি করতে উদ্যত হলে ওয়্যারলেস অপারেটর শাহ আলম তাকে উল্টো গুলি করলে লুটিয়ে পড়েন তিনি। তখন বাইরে থেকে মুক্তিযোদ্ধারাও বিওপি ক্যাম্প আক্রমণ করেন। এসময় গোলাগুলিতে সাদিকের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বাঙালি সিপাহি আশরাফ। তিনিই মহেশপুরের প্রথম শহীদ।
পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে বেপরোয়া হয়ে ওঠে পাকসেনারা। আশপাশের এলাকায় ক্যাম্প করে এলাপাতাড়ি হত্যাযজ্ঞ চালাতে থাকে তারা। তবে যাদবপুরে সবচেয়ে বড় যুদ্ধটি হয় ২২ সেপ্টেম্বর। বেতনা নদীর দক্ষিণ পাড়ে কৃষ্ণপুরের ইসলামপুর গ্রাম। উত্তরে যাদবপুর। মাঝে বেতনা নদী। এই নদীর দুই পাড়ে সম্মুখযুদ্ধ হয়। সেই যুদ্ধের কথা ঠিক সেই জায়গায় এসেই জানাচ্ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম, নূর মোহাম্মদ, শফিকুর রহমান, মো. শুকুর আলী ও আনসার আলী।
সেদিনের সেই বট, কাঁঠাল, তাল গাছগুলোর কোনোটাই এখন নেই। জঙ্গল আছে, তবে সেদিনের তুলনায় নেই কিছুই। নদীতে পানি আছে, তবে এতো আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধ সেদিন ছিল না। শুধু আছে দুঃখভরা স্মৃতির পাথার। বয়রা সাব-সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন হুদার নেতৃত্বে, নির্দেশে ৫টি দল যুদ্ধ করে। প্রতি দলে ছিলেন ২০ জন করে। ইপিআর সদস্যরাও ছিলেন মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে। পাকিস্তানিরা পানি ভয় পেতো। আর এই নদীই ছিল সেদিন মুক্তিবাহিনীর প্রধান ঢাল।
বর্ণি ক্যাম্প থেকে আসা খানসেনারা সকাল থেকেই যুদ্ধ শুরু করে। ওইদিন পাক বাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন মারা যায়। তার লাশ তারা উদ্ধার করতে পারেনি। এতে তারা প্রচন্ড ক্ষেপে যায়। চারদিক থেকে এসে আক্রমণ করে। প্রথমে নদীর এপার থেকে ওপারে যুদ্ধ হচ্ছিল। একসময় দেখা যায় পিছন দিক থেকে অর্থাৎ, ইসলামপুরের দিক থেকেও ‘ইয়া আলী’ বলে আক্রমণ করতে আসছে পাকসেনারা। তখন মুক্তিযোদ্ধাদের পালানোর কোনো পথ ছিল না। সামনেও পাকসেনা, পেছনেও পাকসেনা ।
তখন কমান্ডার নির্দেশ দেন যে যার মতো করে অস্ত্র ফেলে হলেও যেন নিরাপদ অবস্থানে যায়। তখন নদী হয়ে ওঠে তাদের প্রধান আড়াল। নদীতে তখন কচুরিপানা ছিল। এই পানার নিচে ঘাপটি মেরে থাকেন অনেকে। অনেকে ডুব দিয়ে দিয়ে নিরাপদ দূরত্বে সরে যান। অস্ত্র বাঁচানোর জন্য কেউ অস্ত্রও ফেলে দেন নদীতে। এভাবে সেদিন এই বেতনা নদীই হয়ে উঠেছিল মুক্তিযোদ্ধাদের একমাত্র সুরক্ষাবর্ম।
এরই মধ্যে আসরের ওয়াক্তের পর ইপিআর সদস্য আব্দুস সাত্তার মারা যান। তার কপালে গুলি লাগে। তার লাশ কাঁধে বয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন খলিল আর ইয়াকুব নামের দুই যোদ্ধা। এমন সময় কয়েক হাতের মধ্যে এসে যায় পাকসেনারা। তখন লাশ ফেলে পালানোর সময় গুলি লাগে খলিলের পায়ে। সে অবস্থায় তিনি একটি গোবরগাদায় লফিয়ে লুকিয়ে পড়েন। কেউ কেউ আশ্রয় নেন পাশের বিভিন্ন বাড়িতে। কোনো বিপদ সংকেত তারা পাননি। যন্ত্রণাদায়ী সেই গুলির ক্ষত দেখাচ্ছিলেন খলিল। আক্রমণ একটু কমলে সন্ধ্যার দিকে ক্রলিং করে যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে আব্দুস সামাদের বাড়িতে আশ্রয় নেন তিনি। তার আগে নিজের কাছে থাকা গজ-ব্যান্ডেজ দিয়ে বেঁধে ফেলেন ক্ষত। পাশের একটি বাড়িতে আশ্রয় নেন আইয়ুব। তাকে খুঁজে বের করে হত্যা করে পাকিস্তানিরা। এসময় মারা হয় কয়েকজন বেসামরিক মানুষকেও।
পাশে সীমান্ত হওয়ায় যাদবপুরের অনেক মানুষই পালিয়ে প্রাণে বেঁচে যায়। পাকসেনারা এলে মধুপুর চলে যাওয়ার জন্য গ্রামে গ্রামে নির্দেশনা ছিল। মিত্রবাহিনীর সহযোগিতায় গেরিলা যোদ্ধারা বিহারে ট্রেনিং শেষে আসতো কৃষ্ণপুর ও ইসলামপুরসহ বিভিন্ন গ্রামে। আবুল কাশেম, নূর মোহাম্মদ,জীবন মিয়া, আফু মিয়া, জাহিদসহ বিভিন্ন পরিবার পালা করে বিভিন্ন গ্রুপকে খাওয়াতো। মুক্তিযোদ্ধা শফিকুল, শুকুর ও আনসার স্বীকার করলেন সেকথা।
খাবারের মেন্যু ছিলো নিজেদের ফলানো খেসারি ডাল, চাল আর সবজি। গ্রামে সবসময় মুক্তিবাহিনী আসতো। পালা করে পুরো দলকে খাবার দিতো গ্রামের মানুষ। একটি দল চলে গেলে আরেকটি দলের কথা বলে যেত তারা।
৭ জনকে জ্যান্ত কবর দেওয়ার আগে পানি খাওয়ান শফিউল। শফিউল ইসলামের বয়স তখন ১০। কুখ্যাত বর্ণি ক্যাম্পের পাশেই তার বাড়ি। একদিন খানসেনারা এসে তাকে এক বালতি পানি আনতে বলে। ধরে আনা আটজনকে দাঁড় করানো হয় একটি গর্তের পাশে। একটি ৮ বছরের শিশুও ছিল দলে। এদের একজন পালাতে গিয়ে গুলি খেয়ে মরে। বাকিদের সেই বালতির পানি পান করিয়ে জীবন্ত মাটিচাপা দেওয়া হয়।
এ জায়গা থেকে ৫০ গজ দূরে হত্যা করা হয় বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যান শহীদুল ইসলামের বাবা ও ভাইকে। পাশের আরেক স্থানে ৫জন, এক স্থানে তিনজনের কথা বলতে পারে মানুষ। এছাড়া বিক্ষিপ্তভাবে মারা পড়ে অসংখ্য। বর্ণি দীঘিরপাড়ও ছিল গণকবরের স্থান।
ঘটনার বর্ণনা করেছেন :
এই এলাকায় সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেওয়া মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম, নূর মোহাম্মদ, শফিকুর রহমান, মো. শুকুর আলী ও আনসার আলী, কামাল উদ্দিন, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা খলিলুর রহমান, হত্যার প্রত্যক্ষদশী শফিউল ইসলাম ও আব্দুস সাত্তার।
ঝিনাইদহ প্রতিনিধি
Discussion about this post