ধর্ষন, গণহত্যা, বাড়ি ঘরে অগ্নিসংযোগ, অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্যদের হত্যা, পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১২ ডিসেম্বর গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলা শত্রুমুক্ত হয়।
সাধারণ নিরীহ মানুষের ওপর পাকবাহিনীর অত্যাচার, রাজাকারদের মাধ্যমে বাড়ি থেকে ধরে পাকিস্তানী ক্যাম্পে নিয়ে নারী ধর্ষন, মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার অপরাধে মুক্তিযোদ্ধার বাবা, ভাই, আতœীয় স্বজনদের হত্যা করে গণকবর দেয়া, অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্যদের প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যাসহ নানারকম ধংসযজ্ঞের মধ্য দিয়ে শ্রীপুর থেকে পাক সেনাদের বিতাড়িত করেন মুক্তিযোদ্ধারা। শ্রীপুর থেকে পাকসেনাদের যোগাযোযোগের জন্য রেলপথ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। চারদিক থেকে আক্রমণের পর ১২ ডিসেম্বর শ্রীপুর ছেড়ে যেতে বাধ্য হয় পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এবং আতœগোপনে চলে যেতে থাকে রাজাকার ও তাদের দোসররা।
১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর ভোরে ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথ নিরাপত্তার দায়িত্বে পাকিস্তানী সেনাদের সাথে শ্রীপুরের উজ্জতপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখযুদ্ধ হয়। গোসিঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র কিশোর সাহাব উদ্দিন ওই যুদ্ধে শহীদ হন। মুক্তিযোদ্ধাদের হামলায় সেখানে চারজন রাজাকার ও একজন পাকসেনাও নিহত হয়।
বাবার লাশটিও পেলেন না ॥
গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার কেওয়া আকন্দবাড়ী গ্রামের শহীদ সাদির আকন্দের ছেলে নুরুজ্জামান আকন্দ বলেন, ১৯৬৫ সনে তাঁর বাবা তৎকালীন সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তরুন যুবকদের প্রশিক্ষিত করে তোলার ভয়ে পাকিস্তানী সেনা সদস্যরা অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্যদের চিহ্নিত করে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। ১৯৭১ সনের ৩ এপ্রিল টঙ্গী অলিম্পিয়া টেক্সটাইল মিলের সামনে ফজরের নামাজ শেষে তাঁর বাবা বাসায় ফিরছিলেন। তখন দেশে কারফিউ চলছিল। ওই অবস্থায় তাঁর বাবা পাক সেনাদের সাথে মানুষ হত্যার প্রতিবাদ করেছিলেন। কথোপকথনে অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য হিসেবে তাঁর পরিচয় পাওয়ার পর সাতটি বুলেটের আঘাতে পাকিস্তানী সেনারা নির্মমভাবে তাকে হত্যা করে। সবশেষে তার লাশটিও রেখে যায়নি হানাদারেরা। স্বজনরা বিভিন্নস্থানে খুঁজে আজও তার সন্ধান পান নি।
একে একে ১০জনকে বেঁধে এনে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা ॥
শ্রীপুরের সাতখামাইর গ্রামের আব্দুস ছাত্তারের স্ত্রী হারেছা খাতুন বলেন, পাকিস্তানী সেনারা তার স্বামীকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করেছে। তার স্বামীর সঙ্গে একই এলাকার ইউসুফ আলী, আজম আলী, আব্দুল লতিফ,গিয়াস উদ্দিন, ছসু মোল্লাসহ মোট ১০জনকে হত্যা করে সাতখামাইরে গণকবর দেয়া হয়। তাদের মধ্যে সাত মাসের সন্তান সম্ভবা সালেহা এবং অপর যুবতী শিরীনকে পাকিস্তানী সেনারা শ্রীপুরে তাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। যুদ্ধ শেষে শ্রীপুরের জিনেজানের রেলসেতুর কাছ থেকে তাদের মাথার চুল, কঙ্কাল এনে গণকবরে সমাহিত করা হয়।
শ্রীপুর বধ্যভূমিতে ১২ জনের দেহ ॥
শ্রীপুর মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলী কলেজ মাঠের একপাশে ১২ জন শহীদের গণকবর রয়েছে। শ্রীপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের কমান্ডার সিরাজুল হক বলেন, কেওয়া আকন্দবাড়ীর শহীদ আলমগীর বাদশা আকন্দের ছেলে নজরুল ইসলাম আকন্দ মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ায় রাজাকারদের সহায়তায় পাকিস্তানীরা বাড়ি থেকে তার বাবাকে ধরে এনে হত্যা করে। তার বাবা ফকির আলমগীর বাদশা আকন্দের সাথে আরও কমপক্ষে ১১জনকে হত্যার পর গণকবর দেয়া হয়।
পাকসেনাদের অবস্থান ও মুক্তিযোদ্ধাদের পরিকল্পনা ॥
মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকসেনাদের স্থল যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ছিল রেলপথ। ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ এবং উত্তরের জেলাগুলোর সাথে ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথকেই তারা নিরাপদ মনে করত। গোলা বারুদ ও ভারী অস্ত্রশস্ত্র মালবাহী ট্রেনে আনা নেয়া করত। ঝুঁকিপূর্ণ স্থান বিশেষ করে রেল সেতু এলাকায় পাকিস্তানি ক্যাম্প তৈরী করে পাহারা বসিয়ে রাখত।
তিনি বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের পরিকল্পনা ছিল পাক সেনাদের ওপর আক্রমণ করে রেলসেতু ধংস করতে পারলে তাদের যোগাযোগ বন্ধ হবে। এর আগেই ভারত থেকে প্রশিক্ষণ ফেরত গাজীপুরের দুই’শজন মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে যুদ্ধ করছে। সেকশন কমান্ডার মিয়ার উদ্দিনের বাড়ি ডোয়াইবাড়ী গ্রামে। তার পরামর্শে ইজ্জতপুর রেলস্টেশনের দক্ষিণ পাশে রেলসেতু ধংস করার পরিকল্পনা করা হয়। ইজ্জতপুর গ্রামের নূরুল ইসলাম সিরাজী ও তার ভাই জসীম উদ্দিন সিরাজীর বাড়িতে ৬ ডিসেম্বর কমপক্ষে দেড়’শ প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধা সমবেত হন।
পাকি ক্যাম্পের খোঁজ দিতেন বাবুর্চি তমিজ উদ্দিন ॥
পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পে বাবুর্চি হিসেবে কাজ করতেন স্থানীয় তমিজ উদ্দিন। তার মাধ্যমে সেনা ক্যাম্পের খোঁজ খবর নিই। সন্ধ্যার পর পাক সেনা ক্যাম্প আক্রমণের রেকি করি। তার দেয়া তথ্যমতে, ৮/১০ জন পাক সেনা তখন ভারী অস্ত্রেশস্ত্রে ক্যাম্পে অবস্থান করছিল। আমরা গেরিলা যোদ্ধা তাই আক্রমণগুলো সাধারণত রাতেই হত। রাত ১২টার পর পাক সেনা ক্যাম্পের আশপাশে অবস্থান নিতে শুরু করি।
শহীদ হন সাহাব উদ্দিন নিহত হয় চার রাজাজাকার ও এক পাকি সেনা ॥
মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান বলেন, ৭ ডিসেম্বর ভোর চারটায় ফায়ারের শব্দ শোনার পর পাকিস্তানি ক্যাম্পে আক্রমণ করা হয়। পরদিন সকাল সাতটা পর্যন্ত মুহুর্মুহু গুলির শব্দে আশপাশ প্রকম্পিত হয়ে উঠে। মুক্তিযোদ্ধারা দু’দিক থেকেই পাকি সেনাদের ওপর আক্রমণ করতে থাকে। চলতে থাকে গুলি বিনিময়। শ্রীপুরের খোঁজেখানী এলাকার বাসিন্দা ও গোসিঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র সাহাব উদ্দিন ছিল রেলসেতুর পূর্ব পাশে থাকা দলের সামনের সারিতে। গুলি বিনিময়ের একপর্যায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে সাথে সাথেই শহীদ হয় সাহাব উদ্দিন। নিহত হয় একজন পাকিস্তানি সেনাসহ চার রাজাকার।
এদিকে, পাকি সেনারা তাদের ক্যাম্পগুলোতে দিনের বেলা সাধারণত কম সেনা মজুদ রাখত। পাকি ক্যাম্পের বাবুর্চি তমিজউদ্দিনের দেয়া পাক সেনা ক্যাম্পে সৈন্য সংখ্যা বাড়ানো কমানোর সময়ের তথ্যটি আমরা নিশ্চিত হতে পারিনি। ফলে টানা তিন ঘণ্টা সম্মুুখযুদ্ধশেষে পূর্ব পরিকল্পনানুযায়ী পাশের গ্রাম ডোয়াইবাড়ী এলাকার আব্দুস সোবাহানের বাড়ির উদ্দেশে সবাই রওয়ানা হয়। ওইদন বিকেলে আব্দুস সোবাহানের বাড়িতে সমবেত হয়ে দেখি সবাই রয়েছি নেই শুধু সাহাব উদ্দিন। ঘটনার পরদিন ৮ নভেম্বর পাকিস্তানি সেনারা তাদের ক্যাম্প ছেড়ে চলে যায়।
১২ ডিসেম্বর রাজাকার ও শত্রুমুক্ত হয় শ্রীপুর ॥
সম্মুখ যুদ্ধের অপর এক মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল আউয়াল বলেন, ধান গাছের আঁটি দিয়ে পাকিস্তানি ক্যাম্প ও সেতু সাজিয়ে ৬ ডিসেম্বর রাতেই প্রশিক্ষণ নিই। ৭ ডিসেম্বর ভোর চারটায় ইজ্জতপুরে অপারেশনে রেলসেতু ধংস করা হয়। এরপর থেকেই পাকিস্তানী সেনারা শ্রীপুরের বিভিন্ন ক্যাম্প ছেড়ে ঢাকার উদ্দেশে যাওয়া শুরু করে। সর্বশেষ ১২ ডিসেম্বর সম্পূর্ণরূপে রাজাকার ও হানাদারমুক্ত হয় শ্রীপুর।
মোস্তাফিজুর রহমান টিটু, স্টাফ রিপোর্টার, গাজীপুর।
Discussion about this post