প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দেশপ্রেমিক এবং ভালো নৈতিক চরিত্রের অধিকারী হিসেবে গড়ে ওঠার জন্যই ভবিষ্যত প্রজন্মকে দেশের ইতিহাস জানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হওয়ার জন্যই তাদের ইতিহাস জানতে হবে।তিনি বলেন, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে যেন জানতে পারে যে কত মহান ত্যাগের বিনিময়ে আমরা এই স্বাধীনতা অর্জন করেছি। সেই স্মৃতিচিহ্নগুলো তারা দেখবে। সেই স্মৃতিগুলি তারা উপলদ্ধি করবে। অন্তরে ধারণ করবে এবং সেভাবেই নিজেদের চরিত্রকে গঠন করবে, দেশপ্রেমে তারা উদ্বুদ্ধ হবে।প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোববার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের নবনির্মিত বহুতল ভবন উদ্বোধনকালে প্রধান অতিথির ভাষণে এ কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানা নতুন প্রজন্মের মানুষের চরিত্র গঠনের জন্যই জরুরি উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশে পঁচাত্তরের পর এমন একটা সময় এসেছিল- তখন যারা মুক্তিযোদ্ধা, তারা মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান এটা বলতে ভয় পেতো। এটুকু বলতে আতংকগ্রস্ত হতো, দ্বিধাগ্রস্ত হতো। আর যারা সম্পূর্ণ দালালিটা করতে পেরেছে তাদের কথা আলাদা।প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি অন্তত এটুকু দাবি করতে পারি ২১ বছর পর সরকার গঠন করে আমাদের গৃহীত পদক্ষেপে মুক্তিযোদ্ধারা গর্বভরে বলতে পারেন আমি মুক্তিযোদ্ধা।সে সময় জয়বাংলা স্লোগান নিষিদ্ধ ছিল এবং জয়বাংলা স্লোগান দিতে গিয়ে বহু নেতা-কর্মীকে জীবন দিতে হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাদের গুলি করে হত্যা করেছে। তাদের ছুরি মারা হয়েছে। সমাজে তারা নানাভাবে অত্যাচারিত-নিগৃহীত হয়েছে। এমনকি জাতির পিতার ছবি প্রচার হতো না টেলিভিশনে। অনেকের ছবির মধ্যে যদি জাতির পিতার ছবিও থাকতো হাহলে সেই ছবিকে কৌশলে ঢেকে প্রচার করা হতো, এমনকি আঙুল দিয়ে ঢেকে রাখতেও দেখা গেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সত্য কোনদিন চাপা থাকে না। সত্যের শক্তি অনেক বেশি। আজকে সেটাই প্রমাণিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সেই চেতনা ফিরে এসেছে।অনুষ্ঠানের শুরুতে সমবেত কন্ঠে জাতীয় সংগীত পরিবেশন করেন ছায়ানটের শিল্পীবৃন্দ। পরে, স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, কারাগারে নিহত জাতীয় চার নেতা, মহান মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদ ও সম্ভ্রম হারা ২ লাখ মা-বোন স্মরণে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়।মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম ট্রাস্টি জিয়াউদ্দিন তারিক আলী অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন। অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তৃতা করেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। সংস্কৃতি বিষয়কমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর অনুষ্ঠানে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।
প্রধানমন্ত্রী জাদুঘর চত্বরে রক্ষিত শিখা অম্লান প্রজ্বলন করেন এবং মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ফলক উন্মেচনের পর পুরো জাদুঘর ঘুরে দেখেন।কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানায়, গতকালই সেগুন বাগিচার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের পুরাতন ভবন থেকে পুরাতন ও নতুন প্রজন্মের ৭১ জন মিলে পায়ে হেঁটে সেখান থেকে শিখা অম্লান নিয়ে এসে জাদুঘরের প্রবেশ মুখে কালো মার্বেল পাথরের গন্ডির মধ্যে পুনঃস্থাপন করেন। এর ঠিক ওপরেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত একটি যুদ্ধবিমান এবং হেলিকপ্টার ডিসপ্লে’র জন্য রাখা হয়েছে।আগারগাঁওয়ে পঙ্গু হাসপাতালের বিপরীতে প্রায় দুই বিঘা জমির ওপর ৯-তলা এই জাদুঘর ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে। এর আয়তন প্রায় ১ লাখ ৮৫ হাজার বর্গফুট। ভবন নির্মাণ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ১০২ কোটি টাকা। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহৃত অস্ত্র থেকে শুরু করে ব্যবহার্য জিনিসপত্র, একাত্তরের নানা দলিলপত্র, বার্তা, চিঠি মিলিয়ে প্রায় ১৫ হাজার নিদর্শন রাখা হয়েছে। নয় তলা ভবনের ৫ হাজার বর্গফুটের প্রদর্শনী গ্যালারিগুলো শুরু হয়েছে ৪র্থ তলা থেকে। ‘আমাদের ঐতিহ্য আমাদের সংগ্রাম’ শীর্ষক এই গ্যালারিতে বাংলাদেশের প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলনসহ ১৯৭০ সাল পর্যন্ত কালপর্বের নানা নিদর্শন স্থান পেয়েছে। দ্বিতীয় গ্যালারিতে রয়েছে ১৯৭১ সালের জানুয়ারি থেকে আগুন ঝড়া মার্চের ঘটনাবলী, বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ, ২৫ মার্চের পাকিস্তানী বাহিনীর গণহত্যা এবং ১৭ এপ্রিল মুজিব নগর সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান। আমাদের যুদ্ধ এবং আমাদের মিত্র’ শীর্ষক তৃতীয় গ্যালারিতে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের নানা ঘটনা, রাজকারদের তৎপরতা এবং মুক্তিযুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহলের ভূমিকা।চতুর্থ গ্যালারির শিরোনাম আমাদের জয়’।মুক্তিবাহিনীর সম্মুখ যুদ্ধ, মিত্রবাহিনীর অভিযান, বুদ্ধিজীবী হত্যা আর রয়েছে ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ। এ ছাড়া, জাদুঘরে দুটি অস্থায়ী গ্যালারি রয়েছে বিশেষ দিবসে প্রদর্শনের জন্য। উল্লেখ্য, ১৯৯৬ সালের ২২ মার্চ ঢাকর সেগুনবাগিচায় একটি ভাড়াবাড়িতে প্রথম মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজকে আমি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের উদ্বোধনে এসেছি। আমরা দুটি বোন ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িটি পেয়েছিলাম। কিন্তু অন্য কোন সম্পত্তি না থাকলেও আমরা কোনদিন ভাবিনি যে বাড়িটি আমরা ব্যবহার করবো। কারণ, এই বাড়ি থেকেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ৬ দফা দিয়েছেন। এই বাড়ি থেকেই অসহযোগ আন্দোলনের নির্দেশনা যেতো। এই বাড়ি থেকেই জাতির পিতা স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে তৎকালীন ইপিআর’র ওয়্যারলেসের মাধ্যমে দেশবাসীর নিকট ঘোষণা প্রচার করা হয়। বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন টেলিগ্রাম এবং টেলিপ্রিন্টারের মাধ্যমে সেই ঘোষণা আগেই বিভিন্ন জেলায় জেলায় পাঠিয়ে দেন যে, দেশ আক্রান্ত হলেই যেন এই ঘোষণা প্রচার করা হয়। তিনি পাকিস্তানের কারাগার থেকে ফিরে এসে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ও পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এই ছোট বাড়িটাতেই ছিলেন। আর এই বাড়িতেই তিনি জীবন দিয়ে গেছেন। সেই বাড়ি আমরা ব্যবহার করবো আমাদের সেই ধরনের আকাঙ্খা বা লোভ কোনটাই ছিল না।
তিনি বলেন, এই বাড়িকে ঘিরে সবসময় আমাদের একটা চিন্তা ছিল যে, এমন একটা কিছু করবো যা ইতিহাসের স্বাক্ষী হয়ে থাকবে। বাংলাদেশে আর কোন নেতার ছেলে-মেয়ে তাঁদের সম্পত্তি কিন্তু দেয়নি। সবাই ভোগ দখল করেছে। কেউ সেখানে মাল্টি স্টোরিড বিল্ডিং করেছে বা ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজে লাগিয়েছে। একমাত্র আমরা দুই বোন, আমাদের আর কোন জায়গা ছিল না। থাকার মত জায়গাও ছিল না, তারপরও বাড়িটি জাদুঘরের জন্য দিয়ে দিয়েছি।তিনি ’৮১ সালে দেশে ফেরার পর কোন বাড়ি ভাড়াও পেতেন না উল্লেখ করে বলেন, যখনই শুনতো, বাড়ি ভাড়া করতে যেতাম। কেউ বাড়িভাড়া দিত না। একরাত ছোট ফুপুর বাড়িতে একদিন মেঝো ফুপুর বাড়িতে এইভাবে আমাকে থাকতে হতো। তারপরেও আমাদের সিদ্ধান্ত ছিল আমরা এটাকে স্মৃতি জাদুঘর করবো এবং আমরা সেটা করেছি। এটাকে যখন স্মৃতি জাদুঘরে রূপান্তর করি তখন প্রফেসর সালাউদ্দিন আহমেদ, গাজিউল হক, বিচারপতি প্রয়াত কে এম সোবহানসহ, রবিউল হোসাইন, অধ্যাপক মুনতাসির মামুন- আরো অনেককে নিয়ে আমরা একটা কমিটি করি এবং জাদুঘর করার সমস্ত ব্যবস্থা নেই এবং তখনই মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি। কারণ ৩২ নম্বরের বাড়িটি ছোট, সেখানে কতটুকুই বা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ধারণ করতে পারবো। তখনই একটি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর করার প্রস্তাবটা আমিই করেছিলাম। যাতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অন্তত মানুষ জানতে পারে।সেই সময়ে তিনি নানা প্রতিবন্ধকতারও শিকার হন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর প্রবাসে তিনি নির্বাসিত জীবন কাটাতে বাধ্য হন। কারণ দেশে ফিরতে দেয়া হয়নি। তারপর যখন দেশের ফিরলেন তখন তাঁকে এই ধামন্ডির বাড়িতে ঢুকতে দেয়া হয়নি। তিনি রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে ফাতেহা পাঠ করেন।প্রধানমন্ত্রী দেশের দ্রুত উন্নয়নে তাঁর সরকারের পদক্ষেপ তুলে ধরে বলেন, সরকারে আসলে আমরা কিভাবে দেশ চালাবো এ জন্য আমাদের অর্থনৈতিক নীতিমালা ছিল যেজন্য আমরা দ্রুত উন্নয়ন করতে সমর্থ হয়েছি। আমাদের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে আমরা আন্তর্জাতিক মান সম্পন্ন করে গড়ে তুলেছি।
তিনি বলেন, আমাদের দেশ ভৌগোলিক আকারের দিক থেকে ছোট হলেও জনসংখ্যার দিক থেকে আমরা কিন্তু একেবারে কম নই। আর এই জনগণই আমাদের শক্তি। এই জনশক্তিকেই আমরা শিক্ষায়-দীক্ষায় এবং প্রযুক্তির ব্যবহারে উৎকর্ষ করে গড়ে তুলতে চাই। এই কারণে যে ২০২১ সালে আমরা স্বাধীতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করবো। ২০২০ সাল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবার্ষিকী। ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে আমরা মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করতে চাই। আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী আমরা ভিক্ষা চেয়ে নয় বরং বিশ্বে একটি আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে আমরা পালন করতে পারি।ক্ষুধামুক্ত দারিদ্রমুক্ত দেশ হিসেবে যেন পালন করতে পারি, সেই লক্ষ্য নিয়েই আমরার কাজ করে যাচ্ছি।
শেখ হাসিনা বলেন, আজকে আপনারা অনেকেই বিদেশে যান এবং দেখেছেন আগে বাংলাদেশ শুনলেই যেখানে বলত ঝড়, দুর্যোগের, ভিক্ষা চাওয়া জাতি, কিন্তু আজকে আর সে কথা তারা বলে না। তিনি বলেন, আজকে বিদেশিরাই বলে বাংলাদেশ একটা উন্নয়নের রোল মডেল। এটাতো এমনি এমনি হয়নি। সুপরিকল্পিতভাবে নেয়া আমাদের পদক্ষেপ সমূহের জন্যই এটা সম্ভব হয়েছে। আর জাতির পিতার নেতৃত্বে যেহেতু মুক্তিযুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করেছি তাই আমরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসলেই দেশের উন্নতি হয়।বিশ্বের অন্যান্য দেশের বেলাতেও যারা সে দেশের স্বাধীনতার জন্য ত্যাগ স্বীকার করেছিল তারা যখন ক্ষমতায় এসেছে তখনই সেসব দেশের উন্নতি হয়েছে। আর এটা কখনই উড়ে এসে জুড়ে বসাদের দিয়ে হয় না, কারণ তারা নিজেদের আখের গোছাতেই সব সময় ব্যস্ত থাকে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। ইনশাল্লাহ এই দেশ এগিয়ে যাবে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর এদেরশের চেতনাকে সমুন্নত রাখবে। কাজেই এই স্মৃতিগুলো ধরে রাখা জাতীয় প্রয়োজন বলেই আমি মনে করি। সেজন্য আমি আবারো মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সঙ্গে সম্পৃক্ত সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। তিনি বলেন, আমি শুধু এইটুকুই বলব আমাদের লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে এই স্বাধীনতা। লাখো শহীদের এই রক্ত কখনো বৃথা যেতে পারে না। বৃথা যায় না।শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতা সেজন্যই বলেছিলেন যে – বাঙালিকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবা না। তাই কেউ দাবায়ে রাখতে পারে নাই। পারবেও না এবং বিশ্বে আমরা মর্যাদাপূর্ণ দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করবো।
Discussion about this post