বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যার দায়ে দন্ডাদেশপ্রাপ্ত বিদেশে পালিয়ে থাকা একজন আসামিকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে অগ্রগতি আছে বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। এক প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, আমরা দুজনের সম্পর্কে তথ্য জানি। তাদের ব্যাপারে আইনি পদক্ষেপ নিয়েছি। এর মধ্যে আসামি রাশেদ চৌধুরী আমেরিকায় ও নূর চৌধুরী কানাডায়।আমরা মার্কিন সরকার ও কানাডার সরকারের সঙ্গে আলোচনা করছি। আইনি পদক্ষেপ অব্যাহত রয়েছে।তবে তাঁরা সেখানে থাকার জন্য কাগজপত্র পোক্ত করেছেন। কানাডার সরকারসহ অনেক দেশই মৃত্যুদন্ডের বিপক্ষে। তারা এ কারণে ফেরত দিতেও অনীহা দেখাচ্ছে। কানাডায় নূর চৌধুরীর থাকার ব্যাপারে বৈধ কোনো নাগরিকত্ব নাই। তিনি সেখানে একটি আবেদন করেছেন যে, বাংলাদেশে একটি মামলায় তিনি মৃত্যুদন্ডাদেশপ্রাপ্ত, ফেরত পাঠালে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হবে। এ কারণে কানাডা সরকার তাঁকে ফেরত পাঠাতে পারছে না।তবে অপর একজন আসামির ব্যাপারে অগ্রগতি আছে। এখন তা বলা যাবে না, যোগ করেন আনিসুল হক।
আইনমন্ত্রী ওই আসামির নাম, তিনি কোন দেশে আছেন এ ব্যাপারে আর কোনো কিছু জানাতে পারেননি। তিনি বলেন, এই আসামির ব্যাপারে বিস্তারিত বললে যতটুকু অগ্রগতি হয়েছে, তা ব্যাহত হতে পারে।রোববার দুপুরে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে আইনমন্ত্রী এসব কথা বলেন।২০১০ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় এ পর্যন্ত পাঁচ খুনির মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়েছে। আর দন্ডাদেশপ্রাপ্তদের মধ্যে ছয়জন পলাতক। এর মধ্যে কারো কারো অবস্থান জানা যায়নি। তবে বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খুনি শরিফুল হক ডালিম স্পেনে এবং মোসলেম উদ্দিন জার্মানিতে অবস্থান করছেন। এ ছাড়া খন্দকার আবদুর রশিদ ও আবদুল মাজেদের অবস্থান এখনো জানা যায়নি।
গত বছর আগস্ট মাসে একটি গণমাধ্যমকে আইনমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যুদন্ড নিষিদ্ধ না। আর মৃত্যুদন্ড হয়েছে বলে তাঁকে তাঁর দেশে ফেরত পাঠানো হবে না, এমন কোনো অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের নেই। আইনমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর শুরু থেকেই রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত আনার বিষয়টি তুলেছি। আজকে আমি এটুকু বলতে পারি, আমাদের আলোচনায় যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। আমাদের কাক্সিক্ষত যে লক্ষ্য, সেটা যাতে সফল হয়, সে কারণে আমি সব তথ্য দেবো না। তবে এটুকু বলতে পারি, আলোচনা অনেক দূর এগিয়ে গেছে।আজ সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে আইনমন্ত্রী আবার বলেন, আমাদের আইনি পদক্ষেপ অব্যাহত আছে। জিয়াউর রহমান, এইচ এম এরশাদ ও খালেদা জিয়া এদেরকে (খুনিদের) এতটাই পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন যে, তাঁরা বিশ্বের যেখানে আছে সেখানে দানা বেঁধে আছে।
মৃত্যুদন্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামিদের দেশে ফিরিয়ে এনে রায় কার্যকর করা এত সহজ ব্যাপার নয় উল্লেখ করে আনিসুল হক আরো বলেন, খুনিরা যে যেখানে আছে, সেখানে তারা শিকড় গেড়ে আছে। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা : বঙ্গবন্ধুর হত্যা মামলার বিবরণ অনুযায়ী, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নূর চৌধুরী ও সাবেক মেজর বজলুল হুদা সরাসরি বঙ্গবন্ধুকে গুলি করেন। বজলুল হুদার মৃত্যুদন্ডাদেশ এরই মধ্যে কার্যকর করা হয়েছে। নূর চৌধুরী এখনো পলাতক। অপর পলাতক আসামিদের মধ্যে সাবেক সেনাসদস্য ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদ পলাতক রয়েছেন।এ ব্যাপারে কোনো সঠিক সরকারি তথ্য নেই। অপর পলাতক আসামিরা হলেন বরখাস্তকৃত লেফটেন্যান্ট কর্নেল খন্দকার আবদুর রশীদ ও শরিফুল হক ডালিম। ঢাকায় পররাষ্ট্র দপ্তর এর আগে পলাতক আসামিদের মধ্যে জিম্বাবুয়েতে বরখাস্তকৃত লেফটেন্যান্ট কর্নেল আজিজ পাশার স্বাভাবিক মৃত্যু নিশ্চিত করে।১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় এলে এবং ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করার পর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচার শুরু হয়। এই কালো আইনের জন্য এর আগে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচার বাধাগ্রস্ত হয়। সর্বোচ্চ আদালত আপিল ডিভিশনের রায়ের পর ২০১০ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার সাজাপ্রাপ্তদের মধ্যে পাঁচজনের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। তাঁরা হলেন সাবেক লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফারুকুর রহমান, মহিউদ্দিন আহমেদ (আর্টিলারি) শাহরিয়ার রশীদ খান এবং এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ (লাঞ্চার) ও সাবেক মেজর বজলুল হুদা। ঢাকা ও ব্যাংককের মধ্যে প্রত্যাবাসন চুক্তি স্বাক্ষরের পর হুদাকে থাইল্যান্ড থেকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। তবে প্রত্যাবাসন চুক্তি না হলেও সাবেক সামরিক সমর্থিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে বরখাস্তকৃত লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদকে যুক্তরাষ্ট্র ফিরিয়ে দেয়।১৯৭৫-পরবর্তী সময়ে সরকার বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিদেশে বিভিন্ন মিশনে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করে। ১৯৯৬ সাল পযর্ন্ত তাঁরা নানা ষড়যন্ত্র ও দেশে রাজনীতি করার সুযোগ পান। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে এসে কালো আইন ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করায় বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচারের পথ প্রশস্ত হয়। লেফটেন্যান্ট কর্নেল রাশেদ চৌধুরী ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত নাইজেরিয়ায় কনসুলার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর সর্বশেষ বদলি হয় টোকিওতে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার তাঁকে চাকরি থেকে অপসারণ করে।রিসালদার মোসলেউদ্দিনকে তেহরান ও জেদ্দায় পোস্টিং দেওয়া হয়। ক্যাপ্টেন মো. কিসমত হাসেম অটোয়ায় এবং লেফটেন্যান্ট আবদুল মজিদ ত্রিপোলিতে কূটনীতিক হিসেবে চাকরি পান।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. আবদুল আজিজ পাশা রোমে বাংলাদেশ মিশনে ফার্স্ট সেক্রেটারি হিসেবে নিয়োগ পান। আজিজ পাশা ১৯৮০ সালের ১৭ জুন অভ্যুত্থান ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ঢাকায় গ্রেপ্তার হন। পরবর্তী সময়ে তিনি অভ্যুত্থান সম্পর্কে সাক্ষ্য দিতে সম্মত হওয়ায় সরকারের সঙ্গে একটি সমঝোতায় পৌঁছেন। তাঁকে রোমে কূটনীতিকের চাকরি দেওয়া হয়। আজিজ পাশা নাইরোবিতেও দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর সর্বশেষ পোস্টিং ছিল জিম্বাবুয়ে ডেপুটি হাইকমিশনার হিসেবে। ১৯৯৬ সালের আওয়ামী লীগ সরকারের সময় তাঁকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। পাশা জিম্বাবুয়েতে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন। ২০০১ সালের ২ জুন মারা যান।