তারিখ ঠিক মনে নেই। সেদিন ছিল রোববার। ২০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে আমাদের টিমের সঙ্গে লালমনিরহাটের মোগলহাটে পাক বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ চলছিল। সকাল থেকে বিকেল এই যুদ্ধের মধেই সবাই। তখন বিকেল। পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়েছে সূর্য। হঠাৎ পরপর দুটি গুলিবিদ্ধ হয় আমার পাশে থাকা খাতেব। মাথায় গুলি লাগে। সে লুটিয়ে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। আমরা কয়েকজন তার মরদেহ উদ্ধার করে ভারতের গিতালদহ নিয়ে যাই। সেখানেই দাফন করা হয়।
একাত্তরের এমনই এক স্মৃতিকথা বলছিলেন মুক্তিযোদ্ধা মেহের আলী ছটকু। তিনি লালমনিরহাট জেলার মহেন্দ্রনগর ইউনিয়নের সাতপাটকি গ্রামের ফজলে রহমানের ছেলে। দুই ভাই, তিন বোনের মধ্যে সবার বড় ছটকু। ১৯৪৭ সালের ২ মে জন্মগ্রহণ করেন।
তিনি ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে ৬ নম্বর সেক্টরের অধীনে মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন।
বঙ্গবন্ধুর দেশ স্বাধীনের ঘোষণা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মনটা সবসময় ছটফট করে উঠতো। কিন্তু ওই সময় তার হাতেও কোনো টাকা পয়সা নেই। ভাবছিলেন কি ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা যায়। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হয় বন্ধু তাহের, রায়হান, মজিবর, খয়বর, শমশের ও মমতাজের সঙ্গে। বন্ধু মমতাজ তাদের রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেয়ার পরামর্শ দেন। এ কথা শোনার পর রাগে ক্ষোভে সেখান থেকে উঠে বাড়ি চলে আসে ছটকু।
ওইদিনই দাদীর পিতলের হাড়ি চুরি করে নিয়ে ১৩ টাকায় বিক্রি করেন। রাতে বাড়ির কাউকে কিছু না বলে চলে যান সদর উপজেলার গোকুন্ডা ইউনিয়নের ডা. আমজাদ হোসেনের কাছে। তার কাছ থেকে সার্টিফিকেটও নেয়া হয়। তার সঙ্গে সার্টিফিকেট নিতে আসেন সিদ্দিক সহ আরো চার থেকে ছয়জন। আরো কয়েকজন আসেন। এখন তারা ছয় থেকে সাতজন। ভারত যাবেন। কুচবিহারে প্রশিক্ষণের জন্য যাওয়ার পথে কলাখাওয়ার ঘাটে তাদের আটক করে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। সার্টিফিকেট দেখানো হয়। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্যই ভারতে প্রশিক্ষণ নিতে যাচ্ছেন এ কথা শোনার পরই মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ছেড়ে দেন।
কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ি উপজেলায় গেলে মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেন এমপির সঙ্গে দেখা হয়। তিনি কিছু শুকনো খাবার কিনে দেন। সেগুলো খেয়ে আবারো কুচবিহারের দিকে রওনা দেন। ১৫দিন পর সকালের দিকে কুচবিহারে পৌছেন। কুচবিহারে নাম ঠিকানা লেখার পর সেখান থেকে টাপুরহাট হয়ে আলীপুর জংশন মজিদ ক্যাম্প ট্রেনিং সেন্টারে পৌছেন। সেখানে তার নামে এলএমজি ও থ্রি নট থ্রি নামে দুইটি অস্ত্র দেয়া হয়। অস্ত্র পাওয়ার পর তার ভিতরে সেগুলো চালনা শেখার জন্য তাকে ২৬দিন প্রশিক্ষণ নিতে হয়। তার ট্রেনিং শেষ হলে তাকে গিতালদহ পাঠানো হয় এবং মুক্তিবাহিনীর ২০ জনের একটি দলে তাকে দেয়া হয়।
৭দিন পর সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য চলে মোগলহাটে। মোগলহাটে যুদ্ধ চলাকালীন সময় তার চোখের সামনেই পাক বাহিনীর গুলিতে নিহত হয় খাতেব নামে এক সহযোদ্ধা। মোগলহাটে কৃতিত্বের সাথে পাকবাহিনীকে পরাজিত করে চলে যান কালীগঞ্জ উপজেলার দলগ্রামের বুকশিলা বাজারে। এবার তার সঙ্গে ছিলেন ৩০ জন সহযোদ্ধা। ষেখানে তুমুল যুদ্ধ করে পাক বাহিনীকে মাত্র আড়াই দিনে পিছু হটিয়ে চলে যান ভোটমারীতে।
৬ ডিসেম্বর ভোটমারীতে বাংলাদেশিদের উপর নির্যাতন করা পাক বাহিনীর উপর তারা ঝাঁপিয়ে পড়েন। সেখানেও পাক বাহিনীর সঙ্গে তুমুল যুদ্ধ হয়। যুদ্ধের এক পর্যায়ে পাক হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প ধ্বংস হলে হানাদার বাহিনীরা পালিয়ে যায়। সেখানে তার আরো এক শহিদার নামে সহযোদ্ধা হানাদার বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়। ওইদিনই লালমনিরহাটকে হানাদার বাহিনী মুক্ত ঘোষণা করা হয়। ৬ ডিসেম্বর আজও লালমনিরহাট মুক্ত দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
সেদিন ডান পায়ে গুলিবিদ্ধ হন ছটকু। গুলি লাগার কার আজো তিনি খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাটেন। এ সময় আজিজার ও মতিনসহ তার কয়েকজন সহযোদ্ধা তাকে উদ্ধার করে ভারতের গিতালদহ নিয়ে যায়। সেখানে ২/৩দিন তার চিকিৎসা হয় এবং তিনি কিছুটা সুস্থ হন। পুরোপরি সুস্থ না হলেও ওই অবস্থায় পরদিন ৭ ডিসেম্বর রংপুর জেলার তারাগঞ্জের মন্ত্রনা এলাকায় আবারো হানাদার বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে নামেন।
৬ নং সেক্টরে কমান্ডার জয়দেব বাবুর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন মেহের আলি ছটকু। দেশের অভ্যন্তরে ৬ মাস যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন তিনি। এরপর দেশ হানাদার মুক্ত হয়। কমান্ডার জয়দেব বাবু আজো বেঁচে আছেন। তার বাড়ি লালমনিরহাট জেলার কালীগঞ্জ উপজেলায়।
দেশ স্বাধীনের পর মাত্র ৬ শতক জমির উপর খরের ঘর তুলে অতিকষ্টে জীবনযাপন করেন। পরবর্তীতে শেখ হাসিনার সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতার ব্যবস্থা করেন। এরপরেই টিনের দুইটি ঘর নির্মাণ করলে সেই টিনের বাড়িতেই পরিবারের সকল সদস্য বসবাস শুরু করেন। বর্তমানে অন্যের জমি বর্গা ও কামলা দিয়ে অতিকষ্টে তার সংসার চলছে। এখন তার পরিবারে ৯জন সদস্য।