মেজর শওকত আলী, বীর প্রতিক এবং মেজর তাহের আহমেদ, বীর প্রতীক – ’৭১ এর দুই মুক্তিযোদ্ধা আজ ঝড়ে পড়লেন। (ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্নইলাহি রাজিউন)। আমাদের দু’টি ‘লাইট-হাউস’ এর আলো নিভে গেলো। দুজনেই ১ম বাংলাদেশ ওয়ার কোর্স এর অফিসার।
✪ মেজর শওকত আলী, বীর প্রতিক ✪
মহান মুক্তিযুদ্ধে ১ নম্বর সেক্টরের সাব সেক্টর কমান্ডার মেজর (অব.) শওকত আলী (বীর প্রতীক) মারা গেছেন
মেজর শওকত শারিরীক অসূস্থ্যতা নিয়ে সিএমএইচ চট্টগ্রামে ভর্তি হয়েছিলেন। ০৩ জুলাই রাতে তাঁকে “গুরুতর অসূস্থ্য” ঘোষণা করা হলে মেডিকেল বোর্ড ঢাকায় পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়। দিনব্যাপী আবহাওয়া
খারাপ থাকা সত্বেও হেলিকপ্টার পৌছে যায় বিকেলে। কিন্তু এরই মধ্যে ০৪ জুলাই ২০২০ বিকেল ৫ঃ৫৫ মিনিটে কার্ডিয়াক এ্যারেষ্ট হয়ে সিএমএইচ চট্টগ্রামেই তিনি মৃত্যূবরণ করেন (নন-কোভিড)। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৮ বছর। মেজর (অব.) মীর শওকত আলীর ছেলে মো. ইমরান মোরশেদ আলী খবরের সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, তার বাবা হার্ট, লিভার ও কিডনি রোগে ভুগছিলেন। গত ১০ দিন ধরে সিএমএইচ এ ভর্তি ছিলেন। ইমরান মোরশেদ আলী জানান, রবিবার দুপুরে বন্দর নগরীর গরিব উল্লাহ শাহ মাজারে জানাজা শেষে সংলগ্ন কবরে তার বাবাকে দাফন করা হবে।
মেজর (অব.) শওকত আলী (বীর প্রতীক) মৃত্যুর সময় এক ছেলে, এক মেয়েসহ অসংখ্য গুনগ্রাহী রেখে গেছেন। তার পৈত্রিক নিবাস নওগাঁ জেলার রাণীনগর উপজেলার কট্টেশ্বর গ্রামে হলেও তিনি নগরীর নাসিরাবাদ এলাকায় সপরিবারে বসবাস করতেন। তার বাবা রেলওয়ের চিফ ট্রাফিক ম্যানেজার এম আশরাফ আলী ও মা শিরিন আরা বেগম। শওকত আলীর জন্ম ও বেড়ে ওঠা চট্টগ্রাম শহরেই।
শওকত আলী সেন্ট প্ল্যাসিডস স্কুল থেকে ১৯৬৮ সালে ম্যাট্রিক পাশ করেন। ভর্তি হন চট্টগ্রাম গভর্মেন্ট কলেজে। এরপর ১৯৭০ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন। দ্বিতীয় বর্ষে থাকাকালীন সময়ে শওকত আলী চট্টগ্রামে অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাথে যুক্ত হয়ে ১৯৭১ এর এপ্রিলে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। ১৯৭১ সালে ছাত্র থাকা অবস্থায় তিনি ২৬ মার্চ ১৯৭১ এ চট্টগ্রামে ৮ ইষ্ট বেংগল এর সাথে যোগ দিয়ে কালুরঘাট, রাংগামাটি, ও রামগড়ে যুদ্ধে নিয়োজিত ছিলেন। এর পরে সীমান্ত অতিক্রম করে ১ নম্বর সেক্টরের গেরিলা বাহিনীতে যোগ দেন। ০৯ অক্টোবর ১৯৭১ সালে তিনি ২/লেঃ হিসেবে কমিশন লাভ করেন। ০৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে তিনি “কে-ফোর্স” এর সাথে চট্টগ্রাম অভিমুখে অগ্রাভিযানে অংশ নিয়ে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখের বিকেলে চট্টগ্রাম শত্রুমুক্ত করেন। ১২ অক্টোবর সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে যোগ দেন ১ নম্বর সেক্টরে। সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর রফিকুল ইসলাম। মুক্তিযুদ্ধে তিনি চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি যুদ্ধ এবং হেঁয়াকো-নাজিরহাট এলাকায় একাধিক লড়াইয়ে অংশ নেন।
✪ মেজর তাহের আহমেদ, বীর প্রতীক ✪
একাত্তরের রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর (অবঃ) তাহের আহমেদ বীরপ্রতীক হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শনিবার রাত ৯:০০ ঘটিকায় সিএমএইচ ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিউন।
মুক্তিযুদ্ধ তাহের অাহমেদ বীর প্রতীক এর অবদান, শেরপুর জেলার নকলা উপজেলার ব্রহ্মপুত্র নদের কাছে বুরেরচরের যুদ্ধে তাহের আহমেদ যথেষ্ট রণকৌশল প্রদর্শন করেন। তার নেতৃত্বে সেখানে জামালপুরের বেগুনবাড়ি সেতু ধ্বংসের উদ্দেশ্যে একদল মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান নিয়েছিলেন সেখানে। সেই সময় ট্রেনে একদল পাকিস্তানি সেনা আসলে তিনি আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। পরিকল্পনামতো বেলা ১১টায় তারা একযোগে পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ করেন এবং বিকেল পর্যন্ত যুধের পর পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে নদীর পাড়ে সমবেত হয়। এই সময় তাহের আহমেদ একটি কৌশল প্রয়োগ করেন। তাহের আহমেদের নির্দেশে কয়েকজন গ্রামবাসী নৌকায় করে পাকিস্তানি সেনাদের পার করে দেওয়ার অভিনয় করেন, নৌকা মাঝনদীতে যাওয়ামাত্র গ্রামবাসীরা তার সঙ্কেতে জলে ডুব দেন। তখন মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের ওপর আক্রমণ চালালে পাকিস্তানি সেনারা এই অতর্কিত আক্রমণে নিহত হয়।তাঁর অনেক অবদান রয়েছে।তিনি ওয়ার কোর্স এর বাংলাদেশ এর প্রথম অফিসার মেজর তাহের আহমেদ, বীর প্রতীক স্বপ্ন ৭১ নামে কৃষি, শিক্ষা, বিনোদন ভিত্বিক বাগান, পার্ক গড়ে তুলেছিলেন। সুন্দর চিন্তা ও আদর্শ নিয়ে স্বপ্ন ৭১ গড়ে তুলেছিলেন নোয়াখালীর চাটখিলে।বেশিরভাগ সময়ই থাকতেন পৈতৃক বাড়ি নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলার নিজ ভাওরে গ্রামে। সেখানে সাজিয়েছিলেন ফল-ফুলের বাগানবাড়ি। ১৯৭১ সালে মেলাগড়ে সেক্টর-২ এ ‘গেরিলা’ হিসেবে যোগ দিয়ে যুদ্ধ করেন। ০৯ অক্টোবর ১৯৭১ সালে তিনি ২/লেঃ হিসেবে কমিশন লাভ করে সেক্টর-১১ তে যোগ দেন। সামরিক বাহিনীর চাকুরী শেষে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগ দিয়ে দীর্ঘদিন বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ মিশনে নিয়োজিত ছিলেন। নিলোভ, সৎ, আদর্শবান হিসাবে তিনি সবর্ত্র সমাদৃত ছিলেন। চাটখিল উপজেলার সন্তান, দেশের গর্বিত মুক্তিযোদ্ধা, বীর এই সেনানীর চলে যাওয়া অনেক কষ্টকর।
এ মাটির সন্তান, দেশের গর্বিত মুক্তিযোদ্ধা, বীর সেনানীদের চলে যাওয়া অনেক কষ্টকর। আল্লাহ, তাঁদের রুহের মাগফেরাত কামণা করছি।
তথ্যসূত্র/কৃতজ্ঞতাঃ Maj Gen Jamil D Ahsan BP and Shanto Rahman