এতদিন সুখে টুইটুম্বুর ছিলো হাস্নাহেনার সংসার। দু’টি ছেলেই তার যেমন মেধাবী তেমনি বিনয়ী। ছোটটি দেখতে ঠিক তার বাবার মতো হয়েছে। বড়টিও কম সুদর্শন নয়। উচ্চাকাক্সক্ষী মননশীল এমন ছেলে সচরাচর চোখে পড়ে না। বাবা কামাল মাহমুদকে তার দুটি ছেলেই মনেপ্রাণে আদর্শ মেনে চলে। এমন দুটি ছেলের মা হতে পেরে হাস্নাহেনা যেমন গর্বিত, তেমনি উচ্চ শিক্ষিত সংবেদনশীল উদার মনের সাহসী মুক্তিযোদ্ধা কামাল মাহমুদের স্ত্রী হতে পেরেও।
বিবাহিত জীবনের এতটা বছরে কেউ কোনোদিন হাস্নাহেনার মুখম-লের প্রসন্নভাবটি বিপন্ন হতে দেখেনি। নিজের জন্য তার কোনো চাওয়া নেই। এত স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে থেকেও তার জীবনযাপনের ধারা একেবারে আটপৌরে। নিয়তির দুর্বিপাকে সেই যে একটু ছন্দপতন ঘটেছিলো, তাও একরকম ভুলেই ছিলেন তিনি। কিন্তু আজ এত বছর পর এ বয়সে এসে কী এক অসহনীয় অবস্থার মধ্যে পড়েছেন তিনি। যে কথাটি কাউকে বলার ছিলো না সেই কথাটিই আত্মজ’র কাছে ফাঁস করে দিতে হচ্ছে। বিধাতা কি পারতেন না শেষ রক্ষাটুকু করতে?
কম্পিউটার বিষয়ে উচ্চশিক্ষার পাঠ চুকিয়ে বড় ছেলে রিয়াজ মাহমুদ দেশে ফিরে এসেছে। ছেলের জন্যে মনে মনে অনেক মেয়েই তিনি পছন্দ করে রেখেছেন। সময় পেলেই একে একে সে তালিকাটি ছেলেসহ সবার সামনে তুলেও ধরছেন। কিন্তু সেসবের প্রতি ছেলের তাচ্ছিল্যের ভাব লক্ষ করে অবশেষে কামাল সাহেব স্ত্রীকে নিরালায় ডেকে নিয়ে বললেন, ‘তোমার ছেলের নিশ্চয় কাউকে পছন্দ করা আছে, থাকলেও অসুবিধা নেই। ওকে অভয় দাও, দেখবে আসল কথা বেরিয়ে আসবে, আমরাও স্পষ্ট হতে পারবো।’
ঠিক তাই হলো। রিয়াজ বুয়েটে পড়াকালীন এসএসসির এক ছাত্রীকে অংক শেখাতো। মেয়েটিকে তার ভীষণ ভালো লাগতো। বড়লোকের একমাত্র সন্তান সে। মেয়েটির মেধা, তীক্ষè বুদ্ধি, সুডৌল গড়ন এবং দৃষ্টির গভীরতা আজো রিয়াজকে মুগ্ধ করে রেখেছে। সপ্তাহে যেখানে তিনদিন যাওয়ার কথা ছিলো সেখানে রিয়াজ প্রায় প্রতিদিনই যেত ওদের বাসায়। মেয়েটি বোধহয় রিয়াজের মনোভাব বুঝে ফেলেছিলো; কিন্তু মুচকি হাসি ছাড়া তার মুখে আর কোনো অভিব্যক্তির প্রকাশ রিয়াজ খুঁজে পায়নি।
মায়ের কাছে অভয় পেয়ে রিয়াজ সেদিনই বিকেলে চলে গেলো ঝিকাতলা আশাদের দোতলা সেই বাড়িতে। কলিং বেল টিপতেই আশা নিজে এসে দরজা খুলে দিলো। প্রথমে হতচকিত হলো সে। চেনা চেনা মনে হলেও কোথায় যে সেই যুবকটিকে দেখেছে মনে করতে পারছিলো না। জড়তা না কাটলেও দরজা ছেড়ে সে যুবকটিকে বসতে না বলে পারলো না। তারপর সামনের সোফায় বসে কিছুটা মুরব্বিয়ানা ঢঙে প্রশ্ন করলো, আপনাকে কোথায় দেখেছি বলুন তো?
-আমি রিয়াজ মাহমুদ। এরই মধ্যে ভুলে গেছো?
-স্যার আপনি। কী ভীষণ ম্যানলি হয়েছেন। চিনতেই পারছিলাম না। লজ্জা ও অপারগতায় কপালে কিছুটা ভাঁজ খেলে যায় আশার।
-অবশ্য চিনতে না পারারই কথা, পাঁচটা বছর কম নয় কিন্তু!
-হ্যাঁ, আমেরিকা যাওয়ার আগের দিন দেখা করতে এলেন আর খোঁজখবর নেই। ভেবেছিলাম আর দেখা হবে না। মাঝে মাঝে খুব ফিল করেছি আপনাকে।
-তো লেখাপড়া শেষ করলে?
-ইকনমিক্সে এমএ করলাম, এখন ভাবছি কী করা যায়…। কয়েকটি কলেজে আবেদন করে রেখেছি। বিসিএস পরীক্ষাও দিয়েছি।
-আংকেল এখনো ফেরেননি? আন্টি কোথায়?
-আব্বা এখনো ফেরেননি, আম্মা একবছর হলো মারা গেছেন।
-ওহ! সরি। কী হয়েছিলো তাঁর?
-তেমন কোনো রোগ ধরা পড়েনি…।
রিয়াজের ভালো লাগায় যোগ হলে সমবেদনা। আশার ম্রিয়মান মুখখানা নতুন করে সে আবার ভুলতে পারছিলো না। সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ সেই মেয়েটি আবার যেন এসে ভর করলো তাকে। তখনি নয়. দু’দিন পর সব কথা মাকে খুলে বলতেই মা-ই বুদ্ধি দিলেনÑ‘তোর একার পছন্দ হলে তো হবে না বাবা! মেয়েটির সঙ্গে তোর এ বিষয়ে যখন কোনো কথাই হয়নি, তারপর আবার এতদিনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা। মেয়েটিরও তো অন্য কাউকে পছন্দ থাকতে পারে, আগে তার থেকে ধারণা নে। অবস্থা বুঝে আমারই এগুবো।’
আশার আচরণে বাড়াবাড়ি বা জড়তা নেই। চেনা সেই স্মিত হাসি, কিছুটা গাম্ভীর্য এসে অবশ্য তার শ্রী আরো বৃদ্ধি করেছে। যাতে নিজের করে পেতে রিয়াজের আকাক্সক্ষা হয়েছে আরো দৃঢ়।
সেদিনের পর আজ দ্বিতীয়বার আশার মুখোমুখি বসে রিয়াজ। যে কথাটি বলতে এসেছে, তা যেন একেবারেই গৌণ মনে হচ্ছে তার কাছে। মনে হচ্ছে এসবই ফয়সালা হয়ে আছে। মনে হচ্ছে জনম জনম ধরে আশালতা শুধু তার। তবু একটা সিদ্ধান্তে তো আসতে হবে! কোনোধরনের ভূমিকা না টেনে রিয়াজ বলে ফেললো, ‘তোমার যদি অমত না থাকে আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই আশা। প্রস্তাবটি অবশ্য আমার বাবাই তোমার বাবার কাছে রাখবেন। আমি শুধু তোমার মতামতটি জানতে এসেছি।’ হঠাৎ রিয়াজের বলা কথাটি শুনে আশার গোলাপি মুখখানা লাল হয়ে উঠলো। সে সম্পূর্ণ মুখটি ঘুরিয়ে রাখলো অন্যদিকে। রিয়াজ কথাটি আবারও বললে আশা শুধু বললো, ‘সে তো আমার সৌভাগ্য, যদিও এমন করে কখনো ভাবিনি।’
এই মুখ কেন তার ছেলে এতদিন ধরে মনে রেখেছে, তা হাস্নাহেনা আশাকে ঝলকমাত্র দেখেই বুঝতে পারলেন। আশা তার পা ছুঁয়ে সালাম করতেই তিনি তাকে বুকে টেনে নিলেন। দীর্ঘ আশীর্বাদ শেষে লুকিয়ে রাখা আংটিটি পরিয়ে দেয়ার, পরক্ষণেই দেয়ালে টাঙানো একটি ছবির দিকে চোখ পড়তেই হাস্নাহেনা মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেলো। আশাকে বললেন, ‘ও কি তোমার বাবা’? আশা ‘হ্যাঁ’ বলতেই উঠে দাঁড়ালেন হাস্নাহেনা। তারপর রিয়াজের হাত ধরে ‘চল’ বলে টানতে টানতে একেবারে বেরিয়ে গেলেন। হতভম্ব রিয়াজ হোঁচট খেতে খেতে বারবার পেছনে তাকায় আর মাকে বলে ‘তোমার কী হয়েছে বলবে তো?’ কিন্তু কী বলবেন হাস্নাহেনা ছেলেকে?
শঙ্কিত রিয়াজ ওঁৎ পেতে থেকেও কোনো রহস্যের হদিস পায় না। সব সময় প্রফুল্ল হয়ে থাকা মায়ের, আশার প্রতি হঠাৎ এমন মনোভাবের কারণ কী? মারাত্মক একটা কিছু না হলে সরল মনের এই মানুষটি এমন কঠোর হতে পারেন না। রিয়াজ মায়ের ভয়ঙ্কর রূপটি দেখে মরিয়া হয়ে ওঠে। ওদিকে আশার জন্যে মনটা কেমন ছটফট করছে। ঘটনার আকস্মিকতায় ও-ই বা কী ভাবছে!
পরিস্থিতি কিছুতেই স্বাভাবিক হচ্ছে না, তবু সন্তান হিসেবে তারও তো দায়িত্ব, মায়ের কষ্টটি কোথায় তা জেনে লাঘব করা।
গভীর রাতে রিয়াজ মাকে বারান্দায় বসে থাকতে দেখে সাহসে ভর করে কাছে এগিয়ে আসে। হাস্নাহেনা একটুও চমকালো না। খুব কোমল স্বরে বললেন, ‘তুই কেন জেগে আছিস বাবা, রাত জাগিস না।’
এই শীতলতা অসহ্য লাগে রিয়াজের, অসহিষ্ণু কণ্ঠে জবাব দিলো রিয়াজ ‘তুমি কেন এমন করছো মা? আশাকে তোমার পছন্দ না হলে অথবা যে কোনো কারণে তোমার আপত্তি থাকলে আমি ওকে বিয়ে করবো না। তাহলে কোনো সমস্যা থাকার কথা নয়।’
-আসলে কোনো কোনো সমস্যার বোধহয় একেবারেই নিষ্পত্তি নেই রে বাবা।
-মা আমি তোমার ছেলে, আমার বোঝার বয়স এবং বুদ্ধি হয়েছে। তুমি যে কারণে কষ্ট পাচ্ছো তার ভাগ আমাকে তো দিতে পারো! তুমি এমন করে থাকলে রিজভী এবং আমি কি ভালো থাকতে পারি?
-সে আমি জানি, সেই বিশ্বাসেই তো সব গ্লানি চাপা পড়ে গিয়েছিলো।
-কিসের গ্লানি তোমার, বলো মা?
-একদিন যেসব এভাবে উন্মোচিত হয়ে যাবে তা একটি বারও আমার মনে আসেনি।
– তোমার সব কথা আমাকে বলো মা!
এমনি দু’টি ছেলে আমার। এমন স্বামী। সারাক্ষণ খোদার কাছে শুকরিয়া আদায় করে সংসারটাকে পুণ্যভূমির মতো করে গড়েছিলাম। ফেলে আসা কোনো ঘটনাই আমি আর মনে করতে চাইনি। স্বপ্নেও ভাবিনি সেই দুঃসহ ঘটনার রেশ আমাকে আবার এমন ভয়ঙ্কর নাড়া দেবে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকায় মিলিটারির গুলিতে মারা যায় হাস্নাহেনার বাবা। বড় ভাই তখন ইউনিভার্সিটির ছাত্র। হাস্নাহেনা মাত্র কলেজে উঠেছে। ছোট বোনটি স্কুলের শেষের ক্লাসে পড়ে। শোকে মুহ্যমান পরিবারটি ঢাকার ভয়ঙ্কর অবস্থা পাড়ি দিয়ে পায়ে হেঁটে যশোরে তাদের গ্রামে চলে যায়। মা বোনদের বাড়িতে রেখে ভাইটি মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার আগে তাদের সঙ্গে অনন্যোপায় হয়ে জীবন বাঁচাতে যাওয়া ভাইয়ের এক বন্ধুর সঙ্গে হাস্নাহেনার বিয়ে দেয়া হয়। বিয়েতে ভাইয়ের বন্ধুটি, কোনো আপত্তি তো ছিলই না বরং আগ্রহ খানিকটা বেশি ছিলো।
শহর থেকে হঠাৎ আসা দুটি সোমত্ত মেয়ের দিকে গ্রামের বদলোকগুলোর নজর যেন সারাক্ষণ বিঁধে থাকত। হাস্নাহেনাকে বিয়ে দিতে পেরে মা অন্তত স্বস্তি অনুভব করেছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার ক’দিন পর লোকটি তাকে তার নিজের জেলা চট্টগ্রামে নিয়ে যায়। হাস্নাহেনার ভাই তখনো ফিরে আসেনি। মায়ের উৎকণ্ঠা আর দু’বোনেরও নানান ভয়। তবু হাস্নাহেনা মা-বোনকে ছেড়ে স্বামীর সঙ্গে চলে গেলেন। বাড়ির কাছে পৌঁছে লোকটি হাস্নাহেনাকে বললো, ‘তুমি এখানে দাঁড়াও, আমি ভেতরে গিয়ে মাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। একা একা বিয়ে করেছি, হঠাৎ শুনলে বাবা আস্ত রাখবেন না। মৃত্যু জয় করে ছেলে ফিরে এসেছেÑএ আনন্দের চেয়ে ছেলের অবাধ্যতাই তার কাছে বড় মনে হবে। মাকে বুঝিয়ে বললে মা নিশ্চয় ব্যাপারটি ম্যানেজ করতে পারবেন।’
ভর সন্ধ্যায় হাস্নাহেনা একা একা বাগানের মধ্যে দাঁড়িয়ে রইলো। ঘণ্টাখানেক পর হ্যারিকেন হাতে বাড়ির বয়স্কা এক ঝি এসে হাস্নাহেনাকে ভেতরে নিয়ে একা এক ঘরে থাকতে দিলো। সারারাত তার কাছে কেউ আসেনি। কিছু খেতে পর্যন্ত দেয়নি। অন্যান্য ঘর থেকে বাড়ির লোকজনের কথাবার্তা শোনা গেলেও, হাস্নাহেনা তার স্বামীর কোনো সাড়াশব্দই আর টের পেলেন না। পরদিন খুব ভোরে এক বুড়ো চাকর এসে জটিল ভাষায় যা বললো, তা এরকম ‘চলো মা, কর্তা তোমাকে তোমার বাবার বাড়ি রেখে আসতে বলেছেন।’ হাস্নাহেনার মনে আর এতটুকুু জোর ছিলো না স্বামীর সঙ্গে অন্তত আর একটিবার দেখা করে আসার। কেননা তখন দেশের যা অবস্থা, তাকে মেরে যে মাটি চাপা দিয়ে রাখেনি এই তার ভাগ্য।
যশোর থেকে চাঁটগা তখন প্রায় তিনদিনের পথ, যাওয়া আসা মিলে ছদিন পর মুমূর্ষু অবস্থায় হাস্নাহেনাকে ওভাবে ফিরতে দেখে তার মা মূক হয়ে গেলেন। সেদিনই কামাল মাহমুদ আসেন হাস্নাহেনার ভাইয়ের মৃত্যুসংবাদ নিয়ে। বেদনার এতটা ভার একসাথে সইতে পারলেন না হাস্নাহেনার মা। তিনি শেষবারের মতো সেদিনই চোখ দুটি বন্ধ করলেন।
সবটুকু শক্তি দিয়ে জীবন বাজি রেখে যিনি যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছেন, এতগুলো দুর্ঘটনায় পতিত নিহত সহযোদ্ধার পরিবারের সম্মানটুকু তিনি ধুলোয় মিশে যেতে দিলেন না। সব ঘটনা শুনে এবং দেখে হাস্নাহেনাকে কামাল মাহমুদ স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করলেন। কিন্তু হাস্নাহেনা টের পাচ্ছিলেন তিনি অন্তঃসত্ত্বা। কিন্তু কিছুই যে করার ছিলো না তার। দু’টি বোনের জন্য একটু ঠাঁই তখন একান্ত জরুরি ছিলো। কারণ গ্রামে তাদের নির্ভর করার মতো কেউই ছিলো না।
মায়ের জীবনে এমন টানাপোড়েন ইতিহাস শুনে রক্ত হিম হয়ে আসে রিয়াজের। জগদ্দল পাথরের মতো বেদনার এমন ভার বুকে চেপে মা কীভাবে পেরেছেন কলহাস্যে এই বাড়িটিকে ভরিয়ে রাখতে! বাবার মহত্ত্বের গৌরবেও তার চেতনায় ঢেউ খেলে যায়। দেশের কথা উঠলেই মুক্তিযুদ্ধের কথা ওঠে। তখন তার বাবার নামটিও প্রসঙ্গত এসে যায়। এটাকেই সে তার জীবনের বড় গৌরব বলে মনে করে। কিন্তু কে সেই কাপুরুষ-বেঈমান, যে তার মাকে এমন নির্দয়ভাবে অবহেলা করেছে। সে যেই হোক তাকে রিয়াজ ছাড়বে না।
রিয়াজ মাকে বুকে টেনে নিয়ে ব্যাকুল কণ্ঠে প্রশ্ন করলো, সত্যি করে বলো মা, আশার বাবা-ই কি সেই অমানুষ, কাপুরুষ? কথা ঘুরিও না মা!
-হ্যাঁ। হাস্নাহেনা প্রাণের আন্ধার কুঠুরি থেকে এই স্বীকারোক্তিটি বড় কষ্টে উগরে দিলেন।
-এর প্রতিশোধ আমি কীভাবে নিই তুমি শুধু দেখো মা। হাতের মুঠিসহ চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে রিয়াজের।
প্রতিশোধ! এমন মূল্যবান একটি স্পৃহা তীরের মতো ছুঁড়বেন তিনি এক চিনেজোঁকের রক্ত ঝরাতে? ঘৃণায় রি রি করে ওঠে হাস্নাহেনার সমস্ত শরীর। কিন্তু বুঁজে থাকা কণ্ঠে আর কোনো কথাই তার ফুটলো না ছেলের উদ্দেশ্যে। পেলেন না বাধা দেয়ার শক্তি।
ভোর না হতেই রিয়াজ আশার বাবা আমজাদ সাহেবকে তাদের বাড়ির কাজের লোক দিয়ে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলে। আমজাদ সাহেব আড়মোড়া ভেঙে রিয়াজের সামনে এসে বসতে বসতে বলতে লাগলেন, ‘সেদিন তোমার মাকে নিয়ে এসেছিলে শুনে খুব খুশি হয়েছি। আশা আমার একমাত্র মেয়ে। ওর সুখের জন্য আমি সব করতে পারি। আমার বাড়ি-গাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সব ওর। মা মরা মেয়েটি আমার…।
-রাখুন আপনার বাড়ি-গাড়ি-ব্যবসার হিসাব।’
আগুনঝরা দৃষ্টিতে রিয়াজ এতক্ষণ তাকিয়ে ছিলো আমজাদ সাহেবের দিকে কিন্তু তিনি তা খেয়াল করেননি। ধমক শুনেই থতমত খেলেন তিনি। মুখ তুলে তাকালেন।
রিয়াজ ঘৃণা ও ক্রোধ মেশানো গমগমে কণ্ঠে আবারও হুঙ্কার ছাড়লো, ‘আজ আমি অন্য কারণে এসেছি। মিলিয়ে দিতে এসেছি আপনার ভুলে যাওয়া সমস্ত হিসাব।’
আমজাদ সাহেব আরো ভড়কে গেলেন, দিনকাল যা পড়েছে, টাকা পয়সাঅলা মানুষের এমনিতে নানান সমস্যা। কী চায় তার কাছে এই যুবকটি? তিনি আর কিছু বলার আগেই রিয়াজ গর্জে উঠলো, ‘দেখুন তো মনে পড়ে কিনা মুক্তিযুদ্ধের সময় একটা মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে পরে কী তাচ্ছিল্যের সঙ্গে আবার তাকে বের করে দিয়েছিলেন। নিজের সন্তানের পর্যন্ত আর খোঁজ নিলেন না। এত বড় অমানুষ আপনি। পশুরও অধম!’
-তুমি এসব জানলে কী করে? কেঁপে উঠে প্রশ্ন করলেন আমজাদ সাহেব।
-এত্ত বড় বেঈমান আপনি? এত বড় বিশ্বাসঘাতক? ভেবেছেন ভুলে থাকলেই সব মিটে যায়? আমি আপনার যম। আপনার কলিজা বের করে আমি আমার মায়ের হাতে তুলে দেয়ার প্রতিজ্ঞা নিয়ে এসেছি।
দরদর ঘামে ভিজতে থাকেন আমজাদ সাহেব। ভয়ে তার চোখ-দুটো প্রায় বেরিয়ে আসার উপক্রম হয়। সোফা থেকে নিচে পড়ে যান তিনি। গোঙ্গানির শব্দ শুনে আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা আশা দৌড়ে এসে বাবাকে ওঠানোর চেষ্টা করে। ঘৃণায় মুখ বিকৃত করে রিয়াজ দরজার দিকে এগুতেই ‘ভাইয়া’ বলে আশা পথ আগলে দাঁড়ায়।
ডাক্তার এসে পরীক্ষা করে জানালেন আমজাদ সাহেবের স্ট্রোক করেছে। এক্ষুণি হাসপাতালে নিতে হবে, অবস্থা সংকটজনক। পরবর্তী সব ব্যবস্থা রিয়াজকেই করতে হলো। যন্ত্রচালিতের মতো আশাও ছিলো তার সঙ্গে। রাত অনেক হয়েছে, দীর্ঘ অপেক্ষার পরও আমাজাদ সাহেবের জ্ঞান ফিরলো না। ডাক্তার গভীর পর্যবেক্ষণে রেখেছেন তাকে। নার্সের কাছে ফোন নাম্বার রেখে রিয়াজ আশাকে নিয়ে বাড়ি ফিরলো। ঘাত-প্রতিঘাতে দীর্ণ, একটা অমানুষের কঠিন অবজ্ঞায় জর্জরিত ধরিত্রীর মাকে ডেকে সে বললো, ‘মেয়েটিকে তোমার ছোট ছেলের বৌ করে বাড়িতে আশ্রয় দাও মা! এর চেয়ে বড় প্রতিশোধ আমার দ্বারা সম্ভব হলো না। আর মেয়েটি তোমার চার্টার্ড অ্যাকাউনট্যান্ট ছেলের অযোগ্যও হবে না।’
পরম নির্ভরতায় আশা মেনে নিলো রিয়াজ মাহমুদের চরম সিদ্ধান্তটি। কিন্তু আমজাদ সাহেব বাড়ি ফিরলেন অথর্ব অবস্থায়। মানুষ চিনতে পারলেও কথা বলার সাধ্য তার রইলো না। চাকর-বাকর আর প্রতিদিন নার্স এসে তার দেখাশোনা করে। আশাও প্রতিদিন বাঁধাধরা একটি সময়ে বাবাকে দেখে আসে। হাস্নাহেনা আগের মতো এখন আর বাড়ি মাতিয়ে রাখেন না। কামাল মাহমুদ স্ত্রীর এহেন আচরণে ক্ষুদ্ধ হলেও মনে মনে তিনিও দুশ্চিন্তায় ভোগেন।
সহসা এমন পটপরিবর্তনেও বিস্মিত হন। পুত্রবধূটির ওপর হাস্নাহেনার কোনো ক্ষোভ নেই। তবু তিনি পারতপক্ষে তার মুখোমুখি হতে চান না। অথচ একটু সুযোগ পেলেই আশালতা এসে শাশুড়ির গা ঘেঁষে বসে। নিজের জীবনের একান্ত কথাটি শেষ পর্যন্ত ফাঁস হয়ে গেলো এই মেয়েটির কাছেও! ইদানিং নিজেকে বড় ঠুনকো মনে হয় তার। তিনি কি পারতেন না পঙ্কিল সেই অধ্যায়টি না তুলে? রিয়াজকে এ বিয়ে থেকে ঠেকাতেন কী করে তবে!
-মা! রিয়াজ এসে ধ্যান ভঙ্গ করে দেয় হাস্নাহেনার।
-হু।
-আমি টিকেট করে এনেছি। তুমি অনুমতি দিলে কনফার্ম করিয়ে আনবো এবং তা দুচার দিনের মধ্যেই।
-তোর তো আর যাওয়ার কথা ছিলো না? দেশে থেকে যাওয়ার জন্যই তো এসেছিলি!
ধাবমান স্রোতে যেমন ঠেকিয়ে রাখা যায় না। তেমনি একটিমাত্র ঘটনার পরম্পরায় যা ঘটে যাচ্ছে তার সবই যেন তেমনিভাবে হাস্নাহেনার আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে। তিনি বুঝে ফেলেছেন এই যাত্রা থেকে ছেলেকে বিরত করা যাবে না। তাই নিরাসক্ত কণ্ঠে বললেন, মা হয়েও আমি তোর সব সুখ কেড়ে নিলাম, নারে! সব দোষ আমার। জীবনের শুরুটাই যার গলদের, তার শেষটা তো গড়বড়ে হবেই।
-না মা, তোমার কোনো দোষ কোথাও নেই। তুমি নিজেকে কখনো দোষী ভাববে না।
-তাহলে, তুই চলে যাবি কেন, বল?
-এতদিন বিদেশে শুধু লেখাপড়া করলাম। আমার কোনো সঞ্চয় নেই। এখানে ভালো একটা চাকরিও সময় সাপেক্ষ ব্যাপার।
-এসব ভাবনা তোর বাবার ওপর ছেড়ে দিতে পারতি। তিনিই তোকে ফিরে আসতে বলেছিলেন।
-বাবাকে আমি ঠকাতে পারবো না। তার স্নেহে, অর্থে আমি মানুষ হয়েছি। বাবা ডেকে ঋতী হচ্ছি, এও তো শোধ হওয়ার নয়। এখন আর তার একবিন্দু সম্পত্তির ভাগও আমি গ্রহণ করতে পারবো না মা।
-এসব কথা তোর বাবা জানলে কী হবে ভেবেছিস? আমার কথা ভেবেছিস? অস্তিত্বের কী এক সঙ্কট নিয়ে আমার জীবনের এতটা সময় পার হয়ে গেলো। তা’হলে কি আমার বাঁচতে চাওয়াটা দোষের ছিলো? আরো একজনের নিয়তি জড়িয়ে ছিলো আমার সঙ্গে। কী হতো আমার ছোট বোনটির, যদি না তোর বাবা তাকেও প্রতিপালন না করতেন? লেখাপড়া শিখিয়ে বিয়ে দিয়ে সামাজিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত না করতেন!
-আমি কিচ্ছু ভাবতে পারছি না মা, আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।
-এতটা কষ্ট নিয়ে তুই চলে গেলে আমি কি একটা মুহূর্ত স্বস্তি পাবো? তুই কোথাও যাসনে বাবা, মানুষ দুঃস্বপ্নও তো দেখে।
-জীবনের প্রবাহ অদৃশ্য হলেও এত যে উত্তাল মা, তা চোখে দেখা যায় না ঠিকই তবু তাকে রোধ করার সাধ্য কোনো মানুষের থাকে না। যেখান থেকে একটা গৃহকোণকে ঠিকানা জেনে ছুটে এসেছিলাম আজ সেখানটাই আমাকে টানছে। এভাবে হয়তো সমস্ত পৃথিবীটা আমার ঠিকানা হয়ে গেলো। কোনো ঘরই হয়তো আর আমার নির্দিষ্ট ঠিকানা রইলো না। আর কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিত্রাণের আশা গ্লানিকে শুধু প্রকট করে তোলে। তুমি কি চাও মা তেমনি পরিতাপে তোমর সন্তান খাক্ হয়ে যাক?
প্রকৃত সত্যের রূপটি বোধহয় এমনই। নিঃশ্বাস নিতেও ভয় পাচ্ছেন হাস্নাহেনা। এ সময় তার ধৈর্য়ের বাঁধ ভেঙে গেলে কী কৈফিয়ত দেবেন স্বামীকে। নিজের সন্তানও তাকে চাপিয়ে দিচ্ছে তার স্বেচ্ছানির্বাসনের দুঃসহ ভার। সারা শরীরে, মনে ক্লান্তি তবু তিনি অপলক তাকিয়ে থাকেন চোখের সামনে ভেসে ওঠা ধ্বংসস্তূপে। একপশলা দানবীয় তা-ব এসে কেমন করে তছনছ করে দিয়ে গেলো তার সংসার। যা বাগানের মতো সাজানো ছিলো তার অন্তরে-বিশ্বাসে।
Discussion about this post