বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য সরকার চার ধরনের খেতাব দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানিত করে। সর্বোচ্চ খেতাব ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ দেওয়া হয় শহীদ সাতজন মুক্তিযোদ্ধাকে। জীবিতদের মধ্যে সর্বোচ্চ খেতাব বীর-উত্তম পান ৬৮ জন। ১৭৫ জনকে দেওয়া হয় বীর বিক্রম আর ৪২৬ জনকে দেওয়া হয় বীর প্রতীক খেতাব। এই বীর প্রতীক খেতাবপ্রাপ্তদের মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সী হলেন শহীদুল ইসলাম; যাকে লালু নামে ডাকা হতো। মাত্র ১২ বছর বয়সে লালু মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে বীরত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। টাঙ্গাইলের বাসিন্দা লালু মুক্তিযুদ্ধ করেন কাদের সিদ্দিকীর দুর্ধর্ষ কাদেরিয়া বাহিনীর অধীনে। বয়স কম হওয়ায় প্রথমে কমান্ডাররা লালুকে দলে নিতে রাজি ছিলেন না। পরে লালুর অদম্য ইচ্ছায় তাঁকে দলে নেওয়া হয়। এরপর ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়ে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেন লালু।
লালুকে আপনারা নিশ্চয়ই চিনেছেন। না-চেনার তো কোনো কারণ দেখি না। লালু মানে—শহীদুল ইসলাম লালু। দেশের সর্বকনিষ্ঠ ‘বীরপ্রতীক’ খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। মাত্র ১২-১৩ বছর বয়সে সে যুদ্ধে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু তাকে আদর করে ‘বীরবিচ্ছু’ বলে ডাকতেন। সেই যে ঐতিহাসিক ছবিটা—হাফপ্যান্ট-গেঞ্জি পরিহিত, মাথায় ক্যাপ, বঙ্গবন্ধুর কোলে এক কিশোর মুক্তিযোদ্ধা—কার চোখে না-পড়েছে ছবিটা! ছবির এই কিশোরই তো আমাদের লালু…।
শহীদুল ইসলামের বাবা মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন, মা আমিনা বেগম। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন তিনি। ছোটবেলা থেকেই ছিলেন অত্যন্ত সাহসী ও দুরন্ত। মুক্তিযুদ্ধের সময় গোপালপুরে পাক হানাদার বাহিনী ফায়ারিং শুরু করলে স্থানীয়রা প্রাণভয়ে এলাকা ছাড়া শুরু করেন। কিশোর শহীদুলও স্বজনদের সঙ্গে পালিয়ে বর্তমান ধনবাড়ী উপজেলার কেরামজানীতে আশ্রয় নেন। কেরামজানী বাজার ও স্কুলমাঠে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পরিচয় ঘটে তার। মুক্তিযোদ্ধারা তাকে যুদ্ধে অংশ নেওয়ার প্রস্তাব দিলে তিনি রাজি হয়ে যান। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার কাজী হুমায়ুন আশরাফ বাঙ্গাল ও আনোয়ার হোসেন পাহাড়ি কাছে ডেকে নিয়ে ঠিকানা জানতে চান। তারপর থেকেই তিনি মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে কাজে লেগে পড়েন।
মুক্তিযোদ্ধাদের চা-পানি খাওয়ানোর পাশাপাশি মাঝেমধ্যে অস্ত্র পরিষ্কারের কাজও করতেন। এভাবেই অস্ত্র ধরা শেখেন কিশোর শহীদুল। সপ্তাহখানেক পর মুক্তিযোদ্ধা দলের সাথে ট্রেনিং করার জন্য ভারত চলে যান। ভারতে গিয়ে অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে ট্রেনিংয়ে অংশ নিয়ে অস্ত্র হিসেবে স্টেনগান ও গ্রেনেড পান। আর পোশাক হিসেবে হাফপ্যান্ট, গেঞ্জি ও মাথার ক্যাপ। ট্রেনিংয়ের সময় ভারতের তুরা ক্যাম্পে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিণকালে ব্রিগেডিয়ার সামসিং শহীদুল ইসলামের নামের সাথে লালু নামটি যুক্ত করে দেন। সেই থেকে শহিদুল ইসলামের নাম হয়ে যায় শহিদুল ইসলাম লালু। যুদ্ধের পর লালু নামেই পরিচিতি লাভ করেন তিনি। তুরা ক্যাম্পে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিণ চলাকালে প্রতিদিন তিনি সকাল-সন্ধ্যায় হুইসেল বাজিয়ে সব মুক্তিযোদ্ধাদের লাইনে দাঁড় করিয়ে জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে পতাকা উঠাতেন ও নামাতেন। এই কাজের সঙ্গে তাকে সহযোগিতা করতেন শ্যামল চন্দ্র দে ওরফে ভুলু। শ্যামল চন্দ্র দে সে সময় ভোলাভালা নাদুস-নুদুস থাকায় তিনিও ব্রিগেডিয়ার সামসিংয়ে কাছ থেকে সে ভুলু নামে অখ্যায়িত হয়েছিলেন।
তুরায় লালু স্টেনগান ও গ্রেনেড বিষয়ে ভালো শিক্ষা গ্রহন করে সহযোদ্ধাদের সাথে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য টাঙ্গাইলের গোপালপুরের কেরামজানীতে আসেন। তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল গোপালপুর থানায় হানাদারদের বাংকার গ্রেনেড মেরে উড়িয়ে দেওয়ার। বয়সে ছোট বলে সবার অগোচরে এ কাজ সহজে করা যাবে এবং ক্যাম্পের ভেতরে সহজে ঢুকতে পারবেন, শত্র“ বলে সন্দেহও করবে না কেউ, সেজন্য লালুকে এ দায়িত্ব দেওয়া হয়। নির্ধারিত দিনে লালু হাফপ্যান্ট পরে বিকেলে তিনটি গ্রেনেড নিয়ে গোপালপুর থানার উদ্দেশে রওনা হন। থানার কাছে পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে।
থানার গেটের সামনে বটগাছের নিচে যেতেই লালুর গ্রামের এক দূরসম্পর্কের ভাইয়ের সাথে দেখা হয়। সে তখন রাজাকারদের নিয়ে রাস্তা পাহারায় ছিল। লালুকে দেখে জিজ্ঞেস করে, ‘কিরে শহীদ এতদিন কোথায় ছিলি?’ শহীদ উত্তর দেন, ‘কোথায় আর যাব, চারদিকে শুধু গোলাগুলি, আমার ভয় লাগে, তাই নানাবাড়ি গিয়েছিলাম। ’ সে তখন বলে, ‘তুই আমাদের ক্যাম্পে থেকে যা, ওই বাংকারে পাঞ্জাবি সেনাদের চা-টা খাওয়াবি। ’ সুযোগ হাতছাড়া না করে প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান লালু। একদিন গোপনে কেরামজানি ক্যাম্পে যায় লালু। তিনটি তাজা গ্রেনেড নিয়ে আসে। থানার পেছনে জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে রাখে গ্রেনেডগুলো। তারপর অপেক্ষা করে, কবে, কখন সুযোগ আসে…। গ্রেনেড তিনটি থানার পেছনের পুকুরপাড়ে রেখে ক্যাম্পে প্রবেশ করেন। একসময় সুযোগ বুঝে সবার অগোচরে থানার ভেতরের একটি পরিত্যক্ত স্থানে গ্রেনেড তিনটি রেখে তা ব্যবহারের সময় খুঁজতে থাকেন। থানায় তিনটি বাংকার। বাংকারগুলোর একটিতে তিনজন, একটিতে চারজন, অন্যটিতে পাঁচজন হানাদার সব সময় ভারী অস্ত্রসহ পজিশন নিয়ে থাকে। বাকি হানাদাররা রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে গ্রামে গ্রামে অপারেশনে বের হয়…।
২৫ নভেম্বর ১৯৭১। সাঁঝবেলা ঘনিয়ে আসছে। তিন বাংকারে ১২ হানাদার পজিশন নিয়ে সতর্ক অবস্থায় বসে আছে। যারা অপারেশনে বেরিয়েছে, তারা তখনো ফেরেনি। লালু মনে মনে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে ফেলল—আজই, এখনই অপারেশন চালাতে হবে…।
লুকিয়ে রাখা গ্রেনেডগুলো আনতে গিয়ে কিছুটা বিপদের সম্মুখীন হন লালু। গ্রেনেডের ওপর শুয়ে ছিল মস্ত বড় একটা সাপ। সাপ চলে যাওয়ার পর গ্রেনেডের সেফটিপিন খুলে তিনটি গ্রেনেড পর পর তিনটি বাংকারে ছুড়ে মারল। প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরিত হলো। বাংকার তিনটি ছোটখাটো পুকুরের মতো হয়ে গেল…। গ্রেনেড ছোড়ার পর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল লালু। না, কোনো প্রতিরোধ নেই। তার মানে—১২ জনেরই ভবলীলা সাঙ্গ হয়েছে। লালু বাংকারের কাছে গেল। একটা হানাদারও বেঁচে নেই। চারদিকে ছড়িয়ে আছে দলাদলা মাংসপিণ্ড…। এতে তিনটি ব্যাংকারের সবাই মারা যায়। আর সেদিনই মুক্তিযোদ্ধারা গোপালপুর থানা সহজেই দখল করে নেন। লালু থানা থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফিরে আসেন। তিনি যে ফিরে আসতে পারবেন, সে ধারণা কমান্ডারদেরও ছিল না।
সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়ে শহীদুল ইসলাম লালু মুক্তিযুদ্ধের অনন্য ইতিহাস রচনা করেন। এছাড়া তিনি গোপালপুর, ভূঞাপুর, মধুপুর ও নাগরপুরের কয়েকটি রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছেন। অধিকাংশ সময়ে তিনি পাকবাহিনীর ওপর নজরদারির কাজ করতেন। তারা কোথায় অপারেশন পরিকল্পনা করে সব গোপন খবর জোগাড় করে মুক্তিবাহিনীর কাছে পৌঁছে দিতেন। ছদ্মবেশ ধারণ করে অগ্রিম খবর সংগ্রহের ব্যাপারে তার জুড়ি ছিল না। অনেক সময় তার তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই মুক্তিযোদ্ধারা পরবর্তী প্ল্যান তৈরি করতেন।
মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি গন্তব্য বিন্দুবাসিনী বালক বিদ্যালয়। বঙ্গবন্ধু গাড়িতে উঠলেন…। সকাল সাড়ে ১১টা। বঙ্গবন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে মঞ্চে উঠলেন কাদের সিদ্দিকী। সঙ্গে কাদের সিদ্দিকীর অন্যতম দুই সহযোগী—আনোয়ার-উল-আলম শহীদ ও এনায়েত করিম। মাঠে নানা ধরনের ১০ হাজার হাতিয়ার সার করে দাঁড় করানো। তিন হাজার সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাও সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে। অভিবাদন শেষ। এবার আনুষ্ঠানিকভাবে অস্ত্রসমর্পণ। শহরের সব মানুষ—আবাল-বৃদ্ধ, শিশু-কিশোর, নারী-পুরুষ—সবাই ভেঙে পড়েছে বিন্দুবাসিনী বালক বিদ্যালয়ের চারপাশে। অস্ত্র সমর্পণের প্রতীক হিসেবে কমান্ডার হাকিম কাদেরিয়া বাহিনীপ্রধান কাদের সিদ্দিকীর ব্যবহূত স্টেনগানটি প্রসারিত দুই হাতে তুলে দিলেন কাদের সিদ্দিকীর হাতে…।
কাদের সিদ্দিকী বঙ্গবন্ধুর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে তাঁর পায়ের কাছে স্টেনগানটি রাখলেন। কাদের সিদ্দিকী যখন বঙ্গবন্ধুর সামনে হাঁটু গেড়ে বসেছেন, তখন মাঠের তিন হাজার মুক্তিযোদ্ধাও তাঁদের নিজ নিজ অস্ত্র মাটিতে রেখে হাঁটু গেড়ে বসেছেন…। বঙ্গবন্ধু কাদের সিদ্দিকীর স্টেনগানটি তুলে তাঁর ডান পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আনোয়ার-উল-আলম শহীদের হাতে দিলেন। বঙ্গবন্ধুর চোখে আবার জলপ্লাবন নেমেছে। মাঠের সব মুক্তিযোদ্ধার চোখেও জল। আর চারদিকে গগনবিদারী স্লোগান—‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু…।’
বঙ্গবন্ধু মাঠে নেমে অস্ত্র পরিদর্শন করছেন। তাঁর সঙ্গে দেশি-বিদেশি বহু সাংবাদিক ও ফটোগ্রাফার। সারিবদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা ও অস্ত্রের মাঝখান দিয়ে ধীর-পায়ে হাঁটছেন বঙ্গবন্ধু। হঠাৎ তাঁর চোখে পড়ল বাচ্চা একটি ছেলে। বঙ্গবন্ধু সবিস্ময়ে তাকালেন হাফপ্যান্ট-গেঞ্জি পরিহিত ছেলেটির দিকে। কাদের সিদ্দিকীকে উদ্দেশ করে বললেন—‘কাদের, এই বাচ্চা ছেলেটি কে? অও কি মুক্তিযোদ্ধা…?’ কাদের সিদ্দিকী বললেন—বঙ্গবন্ধু, ওর নাম শহীদ। তুরায় ট্রেনিং নেওয়ার সময় ব্রিগেডিয়ার সানসিং ওর নাম দিয়েছিলেন ‘লালু’। আমরাও ওকে লালু নামেই ডাকি। ও একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। গোপালপুর থানায় গ্রেনেড চার্জ করে ১২ হানাদারের ভবলীলা সাঙ্গ করে দিয়েছিল…।
—বলিস কী, কাদের…! এই এতটুকু ছেলে, দুধের বাচ্চা! গ্রেনেড ছুড়েছে…!
বঙ্গবন্ধু লালুর কাছে গেলেন। বললেন—‘আয় আমার বীরবিচ্ছু লালু, তুই আমার কোলে আয়।’ বঙ্গবন্ধু লালুকে কোলে তুলে নিলেন। রাসেলের কপালে যেভাবে চুমু খান, সেভাবেই চুমু খেলেন লালুর কপালে। তারপর দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের বললেন—‘দেখুন, এরাই আমার মুক্তিযোদ্ধা! এই লালুর মতো কিশোর ছেলে যখন যুদ্ধে নামে, তখন কেউ কি আমাদের দাবায়া রাখতে পারে, দেশ কি স্বাধীন না-হয়ে পারে…?’
যখন সহযোদ্ধাদের কাছ থেকে লালুর ব্যাংকার ধ্বংসের কথা শুনলেন তখন বঙ্গবন্ধু তাকে আদর করে কোলে তুলে নিয়ে বলেছিলেন, ‘বীর বিচ্ছু’। সেই ছবি দিয়ে একটি পোস্টারও পরে ছাপা হয়েছিল। শেখ রাসেল ও গোপালপুরের শহীদুল ইসলাম লালু এক মঞ্চে বসে ছিলেন। এই দৃশ্য পরে ‘বাঘা বাঙালি’ ছবিতে দেখানো হয়েছিল।
তবে বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, তিনি যে বীর প্রতীক খেতাব পেয়েছেন সে কথা নিজেও জানতেন না। জেনেছেন বহু পরে, ১৯৯৬ সালে। এর কারণ তিনি থাকতেন প্রত্যন্ত গ্রামে। আর মুক্তিযুদ্ধে জয়লাভ করলেও জীবনযুদ্ধে ছিলেন পরাজিত। অভাব ও দারিদ্র্য ছিল নিত্যসঙ্গী।
এরপর শহীদুল ইসলাম লালু সশস্ত্র বাহিনী দিবস ২০০০, আজীবন সংবর্ধনা ২০০৩, শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া কর্তৃক পুরস্কার ও আর্থিক অনুদান, মিশরের রাষ্ট্রদূত কর্তৃক পুরস্কারসহ আরো অনেক খেতাবে ভূষিত হয়েছিলেন। তারপরও মানবেতর জীবনযাপন করে চার সন্তানের জনক বঙ্গবন্ধুর বীর বিচ্ছু ও দেশের সর্বকনিষ্ঠ বীর প্রতীক শহীদুল ইসলাম লালু ২০০৯ সালের ২৫ মে ঢাকাস্থ মিরপুরে বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় এ বীরের মরদেহ মিরপুরেই সমাহিত করা হয়।
Discussion about this post