জন্ম_পহেলা_নভেম্বর_১৯৫৯_ইং। পিতাঃ শহীদ আবুল হাশিম, মাতাঃ মৃত মাজেদুন্নেসা, গ্রামঃ হাশিমপুর (পূর্বের নাম – টানমান্দাইল), পোঃ ছতুরা শরীফ, উপজেলাঃ আখাউড়া, জেলাঃ ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
১৯৭১ সালের ২২শে অগাস্ট (৭ই ভাদ্র) কসবা যুদ্ধে আখাউড়ার গঙ্গাসাগর দিঘির পারে কুখ্যাত রাজাকার ও জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতা মোবারক আলীর নেতৃত্বে টানমান্দাইল গ্রামের আঠাশ জন ও পার্শ্ববর্তী জাঙ্গাল গ্রামের পাঁচজনকে তাদেরকে দিয়ে একটি গর্ত খুঁড়ে জীবন্ত পুঁতে ফেলে। তাদের একমাত্র অপরাধ ছিল, উনাদের যুবক সন্তানরা কেন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে ভারতে গমন করেছিল!!
ওই গণহত্যায় শহীদ আবুল হাশিম (৪৬) সহ তাঁর আপন তিন ভাই ১। শহীদ আব্দুল খালেক ২। শহীদ গোলাম রব্বানী ৩। শহীদ গোলাম মাওলা ভাতিজা ৪। শহীদ তারা মিয়া সমেত মোট তেত্রিশ জন। শহীদ আবুল হাশিমের জ্যেষ্ঠ পুত্র আবুল খায়ের ভাগ্যক্রমে ও কৌশলে ওই বড় গর্ত থেকে মোবারক আলীদের চক্ষু ফাঁকি দিয়ে বেঁচে যান।
শহীদ আবুল হাশিমের আট ছেলে ও এক মেয়ে। উনার চতুর্থ ছেলে বারো বছর বয়সী আবু সালেককে উক্ত গণহত্যায় ভীষণভাবে আলোড়িত করে। কম বয়সী হওয়া সত্ত্বেও অন্য ভাইদেরকে সাথে নিয়ে যুদ্ধে চরমভাবে জড়িয়ে যায় প্রতিশোধের নেশায়। শহীদ আবুল হাশিমের মেজ পুত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম তার চতুর্থ পুত্র আবু সালেককে অসম্ভব উৎসাহ প্রদান করে। কিশোর মুক্তিযোদ্ধা আবু সালেক অন্যদের সাথে সর্বপ্রথম আগরতলা কংগ্রেস ভবনে অসংখ্য আত্মীয়-স্বজন সহ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছিলেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উচ্চ বিদ্যালয় ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র ছিল আবু সালেক। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে বই খাতা পেলে সীমানা পেরিয়ে কিশোরটি চলে গেল ভারতের আগরতলায়। সেখানে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে লোক বাছাই চলছিল। কিন্তু আবু সালেক বয়সে ছোট হওয়াতে ওকে কেউ-ই যুদ্ধে নিতে চাইল না। বাছাইয়ে না টিকে কান্নায় ভেঙে পড়ল ছেলেটি। ওর কান্না দেখে বাধ্য হয়ে ওকে যুদ্ধে অংশ নেওয়ার সুযোগ দিত হল দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসারদের। আগরতলা থেকে আবু সালেক নিয়ে যাওয়া হলো মেলাগড় ক্যাম্পে। তারপর বড় যোদ্ধাদের সঙ্গে কিশোর আবু সালেক শুরু করল দেশকে স্বাধীন করার যুদ্ধ। এমনি একদিন ওরা ভীষণ যুদ্ধ করছিল চন্দ্রপুর গ্রামে। আবু সালেক সেই যুদ্ধে ছিল বাংকারে। প্রচণ্ড গোলাগুলি চলছে। মুক্তিবাহিনীর একপর্যায়ে টিকে থাকাই মুশকিল হয়ে দাঁড়াল। এখন ওদের সামনে একটাই রাস্তা, পিছু হটতে হবে। আর পিছু হটতে হলে একজনকে তো ব্যাকআপ দিতে হবে। নইলে যে সবাই মারা পড়বে। এগিয়ে এলো সবার ছোট কিশোর আবু সালেক। ছোট্ট কাঁধে তুলে নিল বিশাল এক দায়িত্ব। ক্রমাগত গুলি করতে লাগল পাকবাহিনীর ক্যাম্প লক্ষ্য করে। আর সেই অবসরে নিরাপদ আশ্রয়ে সরে গেল অন্যরা। ও কিন্তু গুলি করা থামাল না আবু সালেক। তার গুলির ধরন দেখে পাকবাহিনী মনে করল, মুক্তিযোদ্ধারা খুব সংগঠিতভাবে আক্রমণ চালাচ্ছে। ফলে ওরাও পিছু হটে গেল। বাংকারে থেকে গেল শুধু আবু সালেক। একসময় রাত শেষ হয়ে সকাল হয়ে গেল। মুক্তিযোদ্ধারা ভেবেছিল আবু সালেক নিশ্চয়ই শহীদ হয়েছে। কিন্তু বাংকারে গিয়ে সবাই দেখল কিশোর আবু সালেক একা বাংকারে বসে আছে।
পূর্বের_ঘটনা_অত্যন্ত_রোমাঞ্চকরঃ ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র কিশোর আবু সালেক ২৮শে মার্চ, ১৯৭১ সালে বাড়ি থেকে পালিয়ে এলাকার অন্যান্য যুবকদের সঙ্গে নিয়ে দুই মাইল দূরত্বে আগরতলা কংগ্রেস ভবনে পৌঁছে যায়। তিনদিন আগরতলায় অবস্থানের পর ভারতীয় সেনাবাহিনীর চরম আপত্তির মুখে কিশোর আবু সালেক কে প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে পাঠাতে অপরাগতা প্রকাশ করে। স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর কিশোর আবু সালেকের অসম্ভব কান্নাকাটির পর ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ত্রিপুরা আসামের দুর্গম সীমান্ত #অম্পিনগর সেনা ক্যাম্পে পাঠায়। সেখানে ২১ দিনেরো বেশী প্রশিক্ষণ দেওয়ার পর ৩০শে এপ্রিল ত্রিপুরা রাজ্যের মেলাঘর রিজার্ভ ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়া হয়। রিজার্ভ ক্যাম্পে ২৫ দিন অবস্থান করার পর শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হাবিলদার আবদুল হালিমের নেতৃত্বে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা আবু সালেক সহ ২৫ জন নিয়ে কসবা থানার ঠিক বিপরীতে ভারত সীমান্তের দেবীপুর ক্যাম্পে অবস্থান নেয়। ০৫ই মে তারিখ হতে সেখান থেকে শুরু হয় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যুদ্ধের পরিকল্পনা। প্রতিদিন রাত দশটার দিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে একেক জনের নেতৃত্বে দশজন করে রেড এ্যামবুশ নিয়ে থাকার পর, হঠাৎ করে পাক হানাদার বাহিনী আসা-যাওয়ার পথে মুক্তিকামীরা অতর্কিত হামলা চালাতো। হামলার পর মুক্তিযোদ্ধারা নিজ ক্যাম্পে ফেরত যেতো। এরকম ভাবে চলতে থাকে পুরো অক্টোবর মাস পর্যন্ত।
রাজাকার_মোবারক_কর্তৃক_গঙ্গাসাগর_গণহত্যাঃ
ইতিমধ্যে ২২শে আগস্ট, ১৯৭১ (৭ই ভাদ্র) কুখ্যাত রাজাকার কমান্ডার মোবারক আলী কর্তৃক কিশোর ও যুবক মুক্তিযোদ্ধাদের জন্মদাতা অভিভাবকসহ তেত্রিশ জনকে জীবন্ত পুঁতে ফেলে ঐতিহাসিক গঙ্গাসাগর দিঘির পাড়ে। কিশোর মুক্তিযোদ্ধা আবু সালেক তার জন্মদাতা পিতা, চাচা ও আত্মীয়-স্বজনের জীবন্ত কবরের খবর পেয়ে থাকেন অক্টোবর মাসের শেষের দিকে। যুদ্ধক্ষেত্রে থাকাকালীন সময়ে তাদের কারও পক্ষেই নিজ জন্মভূমিতে একদিনের জন্যও আসা সম্ভব হয়নি।
কিশোর_মুক্তিযোদ্ধা_আবু_সালেকের_বীর_প্রতীক_খেতাব_অর্জনের_ইতিহাসঃ
২২শে_সেপ্টেম্বর আনুমানিক রাত ০৮টার সময় ১৫ জনের একটি যোদ্ধার দল দেবীপুর_ক্যাম্পের পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশের চন্দ্রপুর গ্রামে অবস্থানরত ক্যাম্পে পাকহানাদার বাহিনীর উপর অতর্কিত আক্রমণ চালানোর উদ্দেশ্যে অবস্থান নেয়। পরবর্তীতে রাত দশটার সময় পাক হানাদারদের আনাগোনার সময় মুক্তিযোদ্ধারা বাঙ্কার থেকে হানাদার বাহিনীর উপর আক্রমণ চালায়। প্রায় ত্রিশ মিনিট উপর্যপুরি আক্রমণের পর হানাদার বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। পনের জন মুক্তিযোদ্ধার ইনচার্জ #শহীদুল_হক ঘোষণা করলেন যে, হানাদার বাহিনী পিছু হটলেও আমরা মুক্তিযোদ্ধারা এই জায়গায় আরো এক ঘণ্টা অবস্থান করবো। আনুমানিক রাত বারো ঘটিকার সময় হানাদার বাহিনী পুনঃশক্তি ও লোকবল সঞ্চয় করে মুক্তিবাহিনীর উপর অনবরত গুলিবর্ষণ করতে থাকে। পাক বাহিনীর আক্রমণে পনের জন মুক্তিযোদ্ধা টিকতে না পেরে পিছু হটার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু পিছু হঠার কোনো সুযোগ ছিল না, কেননা অনবরত গুলির কারণে পিছনে হঠা যাচ্ছিলো না। কিশোর মুক্তিযোদ্ধা আবু সালেক নিজেই সিদ্ধান্ত নিল, একমাত্র তিনিই শত্রুপক্ষের উপর গুলিবর্ষণ করবেন এবং অন্য ১৪ জন পিছনে সরে যাওয়ার সুযোগ করে দিলেন। কিশোর আবু সালেকের অনবরত গুলিবর্ষণের কারণে রাত আনুমানিক তিনটার দিকে পাক হানাদার বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। আশ্চর্যের বিষয় হলো, কিশোর মুক্তিযোদ্ধা সশস্ত্র অবস্থায় এককভাবে বাঙ্কারে অবস্থান করতে থাকে। ঐ দলের ইনচার্জ শহীদুল হক ও অন্যান্য ১৩ জন মুক্তিযোদ্ধা ধরেই নিয়েছিলেন যে, তাদের সবচেয়ে কম বয়সী সাথী মুক্তিযোদ্ধা আবু সালেক আর জীবিত নেই।
কিন্তু ভোর সাড়ে পাঁচটার সময় সবাই বাঙ্কারে গিয়ে দুর থেকে দেখতে পেল কিশোর মুক্তিযোদ্ধা আবু সালেক কাঁধে অস্ত্র রেখে ঘুমাচ্ছে। তাদের সন্দেহ হচ্ছিল আবু সালেক জীবিত কিনা এবং ওই বাংকারে পাক হানাদার বাহিনী কোন বিস্ফোরক বাঙ্কারে রেখে গিয়েছে কিনা। অনেক আলোচনার পর পাশের এক বাড়ী হতে লম্বা একটি বাঁশ এনে সবাই মিলে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা আবু সালেককে গুঁতো দেয়। এতে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা আবু সালেক জেগে উঠে দেখতে পায় ভোর হয়ে গেছে। অতঃপর বাঙ্কারের উপরে উঠে আসে। হঠাৎ করে তার সহযোগী মুক্তিযোদ্ধাদের দেখতে দেখতে পায়। সহযোগী মুক্তিযোদ্ধারা আবু সালেককে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে, কারণ তাদের কাছে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা আবু সালেক বেঁচে থাকাটাই ছিল একটি বিস্ময়কর ঘটনা। উক্ত ঘটনায় দেবীপুর ক্যাম্প ইনচার্জ লেঃ হারুনুর রশিদ বীর প্রতীক ও অন্যান্য মুক্তিযুদ্ধাদের সুপারিশক্রমে কিশোর আবু সালেক #বীর_প্রতীক উপাধি প্রাপ্ত হয়।
২২শে_নভেম্বরে_সম্মিলিত_আক্রমণের_মহাপরিকল্পনাঃ বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন এটিএম হায়দার বীরউত্তম উক্ত এলাকার সাব-সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। ইতিহাসের অন্যতম সেরা বীর শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর খালেদ মোশাররফ বীরউত্তম ছিলেন ঐ সেক্টরের কমান্ডার। মহা পরিকল্পনার অন্যতম সিদ্ধান্ত ছিল ২২শে নভেম্বর ভোর চারটায় মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মিলিত আক্রমণে পাক হানাদার বাহিনীর অন্যতম বড় ক্যাম্প লতুয়ামুড়া দখল নিবে। সেই লক্ষ্যে দেবীপুর মুক্তিযুদ্ধা ক্যাম্পের তৎকালীন অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট হারুন-অর-রশিদ বীর প্রতীক (পরবর্তীতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান) ও অন্যান্য অফিসার বৃন্দ শলাপরামর্শ করে রাত দশ ঘটিকার সময় ক্যাম্পে উপস্থিত সকল মুক্তিযোদ্ধাদেরকে একত্রিত করেন।
ক্যাম্প অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট হারুন-অর-রশিদ বীরপ্রতীক উপস্থিত মুক্তিযুদ্ধের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন এবং বলেন আজ বাংলাদেশ সময় গভীর রাত চারটার সময় উল্লিখিত পাকহানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে আক্রমণ করবে। যারা আক্রমণে অংশগ্রহণ করবে, তারা যেন এক কদম সামনের দিকে আসে। অধিনায়কের এই কথা উচ্চারণের সাথে সাথে, প্রায় চারশত মুক্তিযোদ্ধা মধ্যে মাত্র দুইশত মুক্তিযুদ্ধা এগিয়ে আসে। শেষ পর্যন্ত প্রায় ২৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা স্বইচ্ছায় লেফটেন্যান্ট বীরপ্রতীকের নেতৃত্বে পাকহানাদারদের ক্যাম্প থেকে দুইশত গজ দূরে অবস্থান নেয় ভোররাত চারটার সময়।
ভোর পাঁচটার সময় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অনবরত আক্রমণে পাকহানাদারদের ক্যাম্প লতুয়ামুড়া পর্যুদস্ত হয়ে যায়। অধিকাংশ পাকহানাদার মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। ওই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর বিজয় অর্জিত হয়।
হানাদারদের মর্টার শেলের আঘাতে মারাত্মকভাবে আহত হন কিশোর মুক্তিযোদ্ধা আবু সালেক বীর প্রতীক। দুই হাতে এবং পেটে মারাত্মকভাবে জখম হয় জ্ঞানশূন্য অবস্থা থাকে চারদিন। জ্ঞান ফেরার পর নিজেকে আবিস্কার করে আসামের রাজধান গৌহাটির প্রধান হাসপাতলে। অতঃপর উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রথমে লখনৌ, পুনে, মুম্বাই ও দিল্লিতে চিকিৎসা শেষ হয় ১৯৭২ সালের ১০ই মার্চ।
এরপর ভারত সরকারের বিশেষ আয়োজন কিশোর মুক্তিযোদ্ধা আবু সালেক বীরপ্রতীক সহ ১৭জন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাকে বিশেষ ট্রাভেল পারমিটের মাধ্যমে ভারতীয় সরকার পশ্চিম জার্মানিতে সাত দিনের শুভেচ্ছা সফরে পাঠায়। অতঃপর পশ্চিম জার্মানি থেকে কলকাতা হয়ে ২৮শে মার্চ ১৯৭২ ইং তারিখে বেনাপোল দিয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন।
যুদ্ধপরবর্তী কিশোর বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আবু সালেক বীরপ্রতীক বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সৈনিক হিসেবে যোগদান করেন। সেনাবাহিনীতে নয় বছর চাকরি কালীন সময়ে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় কৃতিত্বপূর্ণ উত্তীর্ণ হয়ে থাকেন।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর এই কিশোর মুক্তিযোদ্ধা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে প্রতিনিয়ত নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে। উপায়ন্তর না দেখে ১৯৮১ সালের প্রথম দিকে সেনাবাহিনী হতে অবসরে চলে যান। এর পরপরই বাংলাদেশ জুট মিল কর্পোরেশন নিরাপত্তা কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন। দীর্ঘ ৩৭ বছর চাকুরীর পর ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে বিজিএমসি থেকে অবসরে যান।
ব্যক্তিজীবনে সর্বকনিষ্ঠ খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আবু সালেক বীর প্রতীক তিন কন্যা ও দুই পুত্রের জনক। তিন কন্যার ইতিমধ্যে বিয়ে হয়ে গিয়েছে। বড় ছেলে শিক্ষাজীবন শেষ করে আর্মি ইঞ্জিনীরিং কোরে চাকরি করে এবং ছোট ছেলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যায়নরত।
যুদ্ধের ময়দানে এই কিশোর ছেলেটি এতটাই বীরের ভূমিকায় ছিলেন যে শ্রদ্ধায় নুয়ে পড়তে হয়েছে রাষ্ট্রকে। সারা দেশে যে ৪২৬ জন বীর প্রতীক উপাধি পেয়েছেন, তাদেরই একজন তিনি। তার নাম আবু সালেক। যখন আক্রমণ শুরু হলো পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের। চলছে গণহত্যা। ভুক্তভোগীদের মধ্যে আছেন সালেকের বাবা আবুল হাসেম। সঙ্গে নেওয়া হলো চাচা আবদুল খালেক, গোলাম মওলা, চাচাতো ভাইসহ ৩৭ জনকে। নেওয়া হলো গঙ্গাসাগর দিঘির পাড়ে। মোবারক রাজাকারের নির্দেশে হত্যা করা হলো সবাইকে।
আবু সালেক দেশের সীমানা পেরিয়ে চলে যান ভারতের আগরতলায়। সেখানে চলছিল রণপ্রস্তুতি। প্রশিক্ষণ নিতে দাঁড়ান লাইনে। কিন্তু এমন কিশোরকে কে যুদ্ধে নেবে? তাই প্রাথমিক বাছাইয়েই বাদ পড়ে গেলেন।কিন্তু তার ভেতরে যে আগুন জ্বলছে, যুদ্ধে যেতেই হবে, শুরু করলেন কান্না। বুঝিয়ে-শুনিয়ে কিছুতেই শান্ত করতে পারছিলেন না বড়রা। এতেই ভেতরের বারুদটা বুঝে যান সবাই। রাজি হলেন প্রশিক্ষণ দিতে। আগরতলায় ত্রিপুরা কংগ্রেস ভবনে নাম তোলার পর নেওয়া হলো মেলাঘর ক্যাম্পে। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ফোর বেঙ্গলের একটি কোম্পানিতে ঠাঁই হলো। চলল কঠোর প্রশিক্ষণ। সব পরীক্ষায় উতরে অস্ত্র চালনা শিখে ফিরলেন সেই কসবায়। সফল অভিযান শেষে ফিরলেন আবার আগরতলায়।
১০ দিন পর চন্দ্রপুর গ্রামে হয় দ্বিতীয় যুদ্ধ। সেখানে সালেকের কারণেই প্রাণে বেঁচে যান সহযোদ্ধারা। মধ্যরাতে পাকিস্তানি বাহিনীর তুমুল গোলাগুলিতে বিপাকে পড়েন মুক্তিযোদ্ধারা। পিছু হটা ছাড়া উপায় ছিল না। কিন্তু সেখানে একজনকে যে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে ‘ব্যাকআপ’ দিতে হয়। ফলে তিনি থাকেন সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে।
অবলীলায় সেই দায়িত্বটা পালন করতে রাজি হয়ে গেলেন সালেক। ছোট কাঁধে পাহাড়সম দায়িত্ব নিয়ে অনবরত গুলি ছুড়তে লাগলেন। আর সহযোদ্ধারা নিরাপদে পশ্চাদপসরণ করলেন। সহযোদ্ধাদের বর্ণনামতে, সালেক এত গুলি ছুড়ছিলেন যে পাকিস্তানিরা ভাবছিল, সেখানে মুক্তিবাহিনীর জোরালো অবস্থান রয়েছে। তারা আর এগোয়নি।
রাত পার হয়, ভোর হয়। থেমে যায় দুই পক্ষের গোলাগুলি। মুক্তিযোদ্ধারা ভাবলেন, সালেকের বুঝি কিছু হয়েছে। বাঙ্কারে গিয়ে দেখেন সালেক ঠায় বসে অস্ত্র হাতে। মুক্তিযোদ্ধারা শ্রদ্ধায় তাকে সেখানেই দেন স্যালুট। এরপর অন্য একটি অপারেশনে গিয়ে বুলেট ও মর্টারের শেলবিদ্ধ হন সালেক। ছড়িয়ে পড়ে তার মৃত্যুর খবর। তিনি কোথায় আছেন, সেই তথ্যও ছিল না। আসলে তিনি ছিলেন ভারতের একটি হাসপাতালে। যুদ্ধ শেষে মার্চে দেশে ফেরেন। স্বাধীনতার পর সালেককে দেওয়া হয় বীরের খেতাব। তার বয়সী আর কেউ এই সম্মান পাননি। বিজয় দিবসের আগে ঢাকা টাইমসের মুখোমুখি হয়েছেন আবু সালেক। কথা বলেছেন তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টি নিয়ে।
এই বয়সে যুদ্ধে গেলেন?
আমাদের বাড়ি আখাউড়ার টান মান্দাইল গ্রামে। আমি পড়ি কসবা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে সপ্তম শ্রেণিতে উঠেছি (প্রমোটেড)। তখন সম্ভবত আমার বয়স বারো কি তেরো। রাজনৈতিক কারণে দেশ উত্তাল। সে কারণে কসবা থেকে আখাউড়ায় চলে আসি। আমরা তো অত কিছু বুঝি না। তবে চারদিকে আলোচনা হচ্ছে পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ অনিবার্য। ৭ মার্চের ভাষণের পর এই যুদ্ধ আরও বেশি স্পষ্ট হয়ে গেল। আমি বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ করতাম যুদ্ধ লেগে গেলে আমরাও যুদ্ধে যাব। মনস্থির করেছি।
যুদ্ধ নিয়ে এত কিছু ভাবতেন ওই বয়সে?
আমি সব যে বুঝতাম, তা তো নয়। তবে এই বিষয়গুলো আমার সঙ্গে আলোচনা করতেন হামিদুল হক। তিনি সম্পর্কে আমার চাচা হন। তিনি আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছেন যুদ্ধে যেতে। ৭ মার্চের ভাষণ তো আমাদের আলোড়িত করেছে। হামিদুল চাচা বলতেন এখানে থাকলে পাকিস্তানিদের কাজ করতে হবে। পাকিস্তানিরা বাড়িতে বাড়িতে হানা দেয়। ছেলেপিলে থাকলে এদের ধরে নিয়ে মেরে ফেলবে, তা না হলে তাদের দিয়ে ক্যাম্পে কাজ করাবে। তাই নিয়ত পাকা যে যুদ্ধে যাবই।
বাড়ি থেকে অনুমতি পেয়েছিলেন?
তত দিনে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। আব্বা-আম্মাকে বললাম যুদ্ধে যাব। কেউ রাজি হলেন না। আমার যুদ্ধে যাবার মতো বয়স হয়নি বলে তাড়িয়ে দিয়েছেন প্রতিবারই। আমি যেহেতু যাব বলে ঠিক করেছি। তাই তক্কে তক্কে ছিলাম কীভাবে যাওয়া যায়। এদিকে যুদ্ধ শুরু হয়েছে এক মাসের বেশি সময় হলো। বাড়িতে বেশ অসুবিধা মনে হচ্ছিল। ভালো লাগছিল না কিছুই।
আপনি যুদ্ধে যোগ দিলেন কখন?
৩০ এপ্রিল রাতে হামিদুল হক চাচার সঙ্গে আগরতলা সীমান্ত দিয়ে পালিয়ে যাই। দেখলাম, বলে যেহেতু কাজ হচ্ছে না, তাই এই পথ বেছে নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায়ও ছিল না। আগরতলায় পৌঁছে বাড়িতে খবর পাঠিয়েছি, আমি যুদ্ধে চলে এসেছি। বাড়িতে আব্বা-আম্মা অনেক চিন্তা করেছে। কিন্তু কেউ আর আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি।
সেখানে গিয়ে কোনো অসুবিধা হয়নি?
অসুবিধা তো হয়েছে আগরতলাতেই। কারণ, ভারত আর বাংলাদেশি সেনারা মিলে কংগ্রেস ভবনে মুক্তিযোদ্ধাদের রিক্রুট করত। কিন্তু সেনা কর্মকর্তারা কোনোভাবেই আমাকে নেবে না। কারণ, আমি নাকি খুব ছোট। আর আমাকে দিয়ে কোনো কাজই নাকি করানো যাবে না। এরা আমাকে কোনোভাবেই নেবে না।
পরে কীভাবে যোগ দিলেন?
আমিও কান্না শুরু করলাম। নানাভাবে অনুনয়-বিনয় করলাম। একজন অফিসারের মায়া হলো। তিনি বললেন আমাকে যেন নেওয়া হয়। পরে এরা অনেকটা বাধ্য হয়েই আমাকে নিয়েছে। আমি ৪ নম্বর রেজিমেন্টে যোগ দিই (২ নং সেক্টর)। সেখানে ট্রেনিং শুরু করেছি। আমি ছিলাম সবার চেয়ে বয়সে ছোট। এ জন্য সবাই অনেক আদর করত।
একটা অপারেশনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন?
নেতৃত্ব নয় ঠিক, আমরা ১০ জনের একেকটা গ্রুপ হয়ে অপারেশনে যেতাম। এই ঘটনাটা ২২ নভেম্বরের আগের। আমার ঠিক মনে আসছে না। আমরা রাত তিন বা চারটার দিকে পাকিস্তানি ক্যাম্পে আক্রমণ করব ঠিক করলাম। সেখানে ২০-২৫ জনের একটা গ্রুপ ছিলাম। রাস্তায় পাকিস্তান আর্মি তখন টহল করছে। আমরা আক্রমণ করি। এরাও তখন পাল্টা আক্রমণ করে। আমাদের একজনকে দায়িত্ব নিতে হবে ক্রমাগত গুলি করার জন্য। এরই মধ্যে বাকিদের নিরাপদে সরতে হবে। তখন আমি দায়িত্ব নিই। আমার কাছে দুই শ বা আড়াই শ বুলেট ছিল। আমি তখন কাভার করি। সঙ্গীরা নিরাপদে সরে যায়। পাকিস্তানিরাও সামনে না এগিয়ে পিছিয়ে যায়। আমি ভোর পাঁচটা পর্যন্ত গুলি করি। পরে একটা সময় সব থেমে যায়।
আপনি নাকি তখন বাঙ্কারে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন?
এই অপারেশনে আমি গুলি করতে করতে হঠাৎ ভোরের দিকে সেখানে ঘুমিয়ে যাই। সহযোদ্ধারা ভেবেছিল, আমি শহীদ হয়ে গেছি। পরে এরা আমার খোঁজ করতে এসে দেখে আমি ঘুমিয়ে আছি। এই অবস্থায় দেখে সবাই ভেবেছে, আমি মরেই গেছি। পরে হঠাৎ জেগে উঠলে আমাকে জড়িয়ে ধরে সবাই।
আপনার বাবাকে পাকিস্তানি সেনারা ধরে নিয়ে গিয়েছিল, তাকে তো আপনি আর দেখেননি…
দিনটা ছিল ৭ ভাদ্র। যাদের সন্তানরা যুদ্ধে গেছে, পাকিস্তানি আর্মিরা তাদের অনেকের অভিভাবককে ধরে নিয়ে গেছে। বাবাকেও সে কারণেই ধরে নিয়ে গেছে। প্রায় ৩৭ জনকে ধরে নিয়ে গেছে। এর মধ্যে আমার আব্বা (আবদুল হাশিম), চাচা আবদুল খালেক ও গোলাম মাওলা, চাচাতো ভাই তারা চান ও আমার বড় ভাই আবুল খায়ের মাস্টার। আমার বড় ভাই কীভাবে যেন পালিয়ে আসতে সক্ষম হন। বাকিদের গঙ্গাসাগর পাড়ে নিয়ে গেছে। হত্যা করার আগে এই মানুষগুলোকে দিয়েই গর্ত তৈরি করেছিল হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরা। একে একে সবাইকে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে। পরে এই গর্তেই সবাইকে পুঁতে ফেলে।
এই হত্যায় জড়িত এই দোসরদের চেনেন?
চিনব না কেন? এরা তো আমাদেরই আশপাশের মানুষ। এদের একজন মোবারক রাজাকার। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে তার বিচার চলছে। একটি মামলায় তার ফাঁসির রায় হয়েছে। বাকিগুলোতেও হবে, আশা করি। এদের মতো যারা চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী, তাদের প্রত্যেকের ফাঁসি কার্যকর করা প্রয়োজন। এরা তো বাংলাদেশি নয়, এরা পাকিস্তানের দোসর। এরা খায় বাংলাদেশের আর কথা বলে পাকিস্তানি সুরে।
শুনেছি তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছিলেন?
‘মোবারক রাজাকার’ যুদ্ধের পর ভোল পাল্টে ফেলে। সে ছিল জামায়াতের রুকন। যুদ্ধের পর আওয়ামী লীগে যোগ দেয়। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার শুরু হলে তাকে উপজেলা আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়। এখন শুধু তার ফাঁসির চূড়ান্ত রায় কার্যকরের অপেক্ষায় আছি।
আপনার পরিবারের আর কেউ যুদ্ধ করেছে?
সবাই অংশগ্রহণ করতে পারেনি। আমরা আট ভাই ও এক বোন। আমি (চতুর্থ) আর আমার ভাই আবুল কালাম (দ্বিতীয়) যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি। বাবা, চাচা আর চাচাতো ভাইদের তো পাকিস্তানিরা মেরেই ফেলল। হাশিমপুর গ্রামের নাম তো আপনার বাবা আবদুল হাশিমের নামে রাখা হয়েছে। জি, এটা আমার বাবার নামে নামকরণ করা হয়। আগে এই গ্রামের নাম ছিল টানমান্দাইল। এখন গ্রামের নাম হাশিমপুর।
আপনার মৃত্যুর সংবাদ ছড়িয়ে পড়েছিল…
২২ নভেম্বর আমরা সবচেয়ে বড় একটি অপারেশন করি। সেটা কসবার লতুয়া মোড়া। যেখানে আমাদের দেড় শর মতো মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়। সেখানেই আমার দুই হাতে বুলেট ও শেলবিদ্ধ হই। অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যাওয়া আমাকে ভারতে চিকিৎসার জন্য নেওয়া হয়। আর আমার সঙ্গে ছিলেন আরেক সহযোদ্ধা আসাদুজ্জামান খান। এরই মধ্যে দেশ স্বধীন হয়েছে। আমি আর অসুস্থতার কারণে দেশে ফিরতে পারিনি। এই সময় সবাই ধারণা করেছে, আমি শহীদ হয়ে গেছি। এর মধ্যে আমি বাড়িতে চিঠি পাঠিয়েছি। কিন্তু বাড়ির কেউ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি।
কখন দেশে ফিরেছেন?
আমার ফিরতে ফিরতে বেশ দেরি হয়ে গেছে। হাসপাতাল থেকে সুস্থ হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ১ বা ২ মার্চ দেশে চলে আসি। ভারতীয় সেনারা আমাকে বেনাপোল দিয়ে যশোর সীমান্তে নামিয়ে দিয়ে যায়। সেখান থেকে খুলনা হয়ে চাঁদপুর দিয়ে আখাউড়ায় এসে পৌঁছাই।
দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের, একজন বীর প্রতীক খেতাব পেয়েছেন।
তখন তো এত কিছু ভেবে যুদ্ধ করিনি। একজন কিশোরের কাছে তার দেশকে ভালো লাগে। সে কারণেই দেশের জন্য আমি সেদিন যুদ্ধে যাই। দেশ আমাকে সম্মান দিয়েছে, এটা আমার কাছে গর্বের। এই ভালো লাগা বলে শেষ করা যাবে না।
তথ্য সূত্রঃ
মুক্তিযুদ্ধা যাদুঘর, সৈয়দ ঋয়াদ, Dhaka Times, Morshed Alam
Discussion about this post