মুক্তিযোদ্ধার অবর্তমানে মাসিক ভাতাসহ সরকারি যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা পাবেন স্ত্রী বা স্বামী। আর তাদের অবর্তমানে সুবিধা ভোগ করবেন পিতা-মাতা। তারাও না থাকলে সুবিধা পাবেন ছেলেমেয়েরা। তাদের কেউই না থাকলে সুবিধা পাবেন মুক্তিযোদ্ধার সহোদর ভাই-বোনরা। এমন সব বিধান রেখে দুই বছর অপেক্ষার পর গত ১৫ জুলাই এ-সংক্রান্ত অফিস আদেশ জারি করেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। তবে সরকারি চাকরি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পোষ্য (নাতি-নাতনি) কোটা চালু থাকলেও মুক্তিযোদ্ধার অবর্তমানে মুক্তিযোদ্ধার ভাতা বণ্টনসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থেকে তাদের (পোষ্য) বঞ্চিত করা হয়েছে। ফলে এ নিয়ে ক্ষোভ বিরাজ করছে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানসহ সংশ্নিষ্টদের মধ্যে।
এ বিষয়ে ‘আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান’ সংগঠনের সভাপতি সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘২০১৮ সালে তথাকথিত এক আন্দোলনের পর প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরি থেকে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের কোটা বাতিল করে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও পোষ্যদের বঞ্চিত করা হয়েছে। এখন মুক্তিযোদ্ধার ভাতা বণ্টনে মন্ত্রণালয় নতুন যে আদেশ জারি করেছে এটিও মুক্তিযোদ্ধার পরবর্তী প্রজন্মের সঙ্গে এক ধরনের প্রবঞ্চনা। কারণ মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিরাই হচ্ছে তার দাদা বা নানার ভাতাসহ সব সুযোগ-সুবিধা ভোগের একমাত্র দাবিদার। এখানে মুক্তিযোদ্ধার ভাই-বোনদের টেনে এনে মুক্তিযোদ্ধার পরবর্তী প্রজন্মকে বংশ পরম্পরার স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ত সরাসরি তার নাতি-নাতনির মধ্যে প্রবাহিত। মুক্তিযোদ্ধার ভাই-বোন অনেকে একাত্তরে স্বাধীনতাবিরোধী ছিলেন এমনও অনেক ঘটনা আছে। তাহলে তাদের ভাতা দেওয়ার আইনি বিধান কতটা যৌক্তিক?’ পরে এ বিষয়টি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের নজরে আনা হলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আমাদেরও নজরে এসেছে। আলোচনা চলছে।’
মুক্তিযোদ্ধার ভাতা বিতরণের পোষ্য কোটা প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘নৈতিকতার প্রশ্নে মুক্তিযোদ্ধার অবর্তমানে তার সন্তান ভাতা পাবেন, তিনি না থাকলে তার সন্তানরা পাবেন, এটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। এটিই হওয়া উচিত। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধার ভাই-বোনরা কেন পাবেন সেটি বোধগম্য নয়; তারা (ভাই-বোন) কি সবাই মুক্তিযোদ্ধার আদর্শ বহন করেন? এটি কোন যুক্তিতে পাবেন। এটি তো ইসলামি শরিয়াহ আইন নয়। সুতরাং মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের অবর্তমানে পোষ্যদের ভাতা পাওয়া উচিত বলে আমরা মনে করি।’
তিনি আরও বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধার ভাই-বোন যে মুক্তিযোদ্ধার উত্তরাধিকার বহন করে তার কী নিশ্চয়তা আছে, আবার মুক্তিযোদ্ধার সন্তান যদি স্বাধীনতাবিরোধী হয় বা স্বাধীনতাবিরোধী দলের সঙ্গে যুক্ত থাকে তাহলে তারা কোনোভাবেই মুক্তিযোদ্ধার ভাতা পেতে পারে না। শুধু রক্তের উত্তরাধিকার নয়, চেতনার উত্তরাধিকার বহন করছে কিনা সেটিও দেখতে হবে। ভাতা বণ্টন নীতিমালা সংশোধন করে বিষয়টি স্পষ্ট করা প্রয়োজন।’
এদিকে মন্ত্রণালয়ের ১১ পৃষ্ঠার নতুন অফিস আদেশ পর্যালোচনায় দেখা যায়, মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা বণ্টনে শৃঙ্খলা আনতে একটি বিধিবদ্ধ পদ্ধতি তুলে ধরা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট আইন ২০১৮-এর ৩ ধারা প্রদত্ত ক্ষমতাবলে এ পদ্ধতি নির্ধারণ করা হয়। এখানে সম্মানী ভাতা পাওয়ার জন্য পাঁচটি শ্রেণি নির্ধারণ করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ক. ভারতীয় তালিকা, খ. লাল মুক্তিবার্তা, গ. গেজেট (বীরাঙ্গনাসহ ১০ শ্রেণি), ঘ. বাহিনীর গেজেট এবং ঙ. জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের সুপারিশক্রমে প্রকাশিত সব গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা। আদেশে সম্মানী ভাতাপ্রাপ্তির অযোগ্যতা, আবেদন যাচাই-বাছাই কমিটি এবং পদ্ধতিও তুলে ধরা হয়েছে।
সম্মানী ভাতা বিতরণ :এ বিষয়ে বলা হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধা একাধিক স্ত্রীর ক্ষেত্রে প্রত্যেক স্ত্রী মৃত মুক্তিযোদ্ধার প্রাপ্য নির্ধারিত ভাতা সমহারে পাবেন; মুক্তিযোদ্ধার একাধিক স্ত্রীর মধ্যে কোনো স্ত্রী মৃত্যুবরণ করলে স্ত্রীর গর্ভে মুক্তিযোদ্ধার ঔরসজাত সন্তান বা সন্তানগণ তার বা তাদের মাতার প্রাপ্য অংশ সমহারে পাবেন; মুক্তিযোদ্ধার তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রী সম্মানী ভাতা পাবেন না। তবে শর্ত থাকে যে, তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীর গর্ভে মুক্তিযোদ্ধার ঔরসজাত সন্তান বা সন্তানগণ একটি পক্ষ হিসেবে বিবেচিত হবে এবং তাদের পক্ষের সম্মানী ভাতা পাবেন। মৃত স্ত্রী বা তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীর গর্ভে মুক্তিযোদ্ধার ঔরসজাত কোনো সন্তান না থাকলে এক বা একাধিক জীবিত স্ত্রী সম্পূর্ণ অংশ বা সমহারে সম্মানী ভাতা পাবেন; মুক্তিযোদ্ধার পিতা বা মাতার মধ্যে যে কেউ জীবিত থাকলে মৃত স্ত্রী বা তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীর গর্ভে মুক্তিযোদ্ধার ঔরসজাত সন্তান বা সন্তানগণ ওই সম্মানী ভাতা প্রাপ্য হবেন না এবং পিতা বা মাতা ভাতার সম্পূর্ণ অংশ সমহারে পাবেন; কোনো নারী মুক্তিযোদ্ধা একাধিকবার বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলে এবং সব স্বামীর সংসারে তার গর্ভজাত সন্তান থাকলে মৃত্যুর পর ওই নারী মুক্তিযোদ্ধার পূর্বের সংসারে তার গর্ভজাত সন্তানরাও একটি পক্ষ হিসেবে বিবেচিত হবেন এবং তাদের পক্ষের সম্মানী ভাতা সমহারে পাবেন; মৃত নারী মুক্তিযোদ্ধার স্বামী জীবিত থাকলে এবং এক বা একাধিক তালাকপ্রাপ্ত বা স্বামীর সংসারে তার গর্ভজাত সন্তান বা সন্তানগণ থাকলে জীবিত স্বামী একটি মৃত পক্ষ হিসেবে বিবেচিত হবেন এবং ওই গর্ভজাত সন্তান বা সন্তানগণ পৃথক পক্ষ হিসেবে বিবেচিত হবেন এবং সব পক্ষ ওই সম্মানী ভাতা সমহারে পাবেন; তালাকপ্রাপ্ত স্বামী সম্মানী ভাতা পাবেন না; কোনো মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী বা স্ত্রীগণ এবং পিতা-মাতা জীবিত না থাকলে মুক্তিযোদ্ধার ঔরসজাত সন্তানগণ সমহারে সম্মানী ভাতা পাবেন। এ ছাড়া মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী বা স্বামীর অবর্তমানে পিতা-মাতা সমহারে সম্মানী ভাতা পাবেন এবং পিতার অবর্তমানে মাতা বা মাতার অবর্তমানে পিতা সম্মানী ভাতার সম্পূর্ণ অংশ পাবেন; মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী বা স্বামী এবং পিতা-মাতার অবর্তমানে সন্তান সম্মানী ভাতা পাবেন এবং সন্তান একাধিক হলে সমহারে সম্মানী ভাতা পাবেন; মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী বা স্বামী, পিতা-মাতা ও সন্তানের অবর্তমানে সহোদর ভাই-বোন সম্মানী ভাতা পাবেন এবং কেবল জীবিত সহোদর ভাই-বোন ওই ভাতা সমহারে পাবেন, কোনো বৈমাত্রেয় ভাই-বোন সম্মানী ভাতা পাবেন না। অফিস আদেশে একইসঙ্গে সম্মানী ভাতা পরিশোধ ও বরাদ্দ পদ্ধতি, ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ভাতা বিতরণ পদ্ধতিসহ ভাতা ফরমও তুলে ধরা হয়েছে।
Discussion about this post