মুক্তিযুদ্ধের ৮নং সেক্টরের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) আবু ওসমান চৌধুরী আর নেই। আজ শনিবার সকালে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। গত ৩০ আগস্ট তাকে সিএমএইচে ভর্তি করা হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন তার ব্যক্তিগত সহকারী আবুল বাশার। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর। তিনি দুই মেয়েসেহ অসংখ্য আত্মীয়-স্বজন ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। আবু ওসমান চৌধুরী সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের (এসসিএফ) সহ-সভাপতি ছিলেন।
আবু ওসমান চৌধুরীর মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। রাষ্ট্রপতি তার শোকবার্তায় বলেন, ‘মহান মুক্তিযুদ্ধে লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরীর অবদান জাতি চিরদিন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।’ রাষ্ট্রপতি শোকবার্তায় মরহুম আবু ওসমান চৌধুরীর রুহের মাগফিরাত কামনা করেন ও তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও আবু ওসমান চৌধুরীর মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন জানিয়েছেন। এ ছাড়া তার মৃত্যুতে আরও শোক জানিয়েছেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ ও সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী মো. আশরাফ আলী খান খসরু, জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন প্রমুখ।
শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে আহ্বায়ক করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী দেশের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক, সাংবাদিক, কবি, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বসহ বিভিন্ন পেশাজীবীদের নিয়ে ১০১ সদস্যবিশিষ্ট ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’র অন্যতম সদস্য ছিলেন লে. কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরী।
আবু ওসমান চৌধুরী ১৯৩৬ সালের ১ জানুয়ারি চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ থানার মদনেরগাঁও গ্রামের চৌধুরী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম আব্দুল আজিজ চৌধুরী এবং মায়ের নাম মাজেদা খাতুন। নিজ গ্রাম মদনেরগাঁওয়ের ফ্রি প্রাইমারি স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন।
১৯৪৫ সালে পার্শ্ববর্তী গ্রামে মানিকরাজ জুনিয়র হাই স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হন।চান্দ্রা ইমাম আলী উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ থেকে ১৯৫১ সালে প্রথম বিভাগে এসএসসি পাস করেন।পরে ঢাকা কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে এইচএসসি ভর্তি হন তিনি, কিন্তু ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ, শারীরিক অসুস্থতা ও পারিবারিক নানা সমস্যার কারণে ঢাকা কলেজে এইচএসসি সম্পন্ন করতে পারেননি। পরে ১৯৫৪ সালে চাঁদপুর সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি ও ১৯৫৭ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে তিনি বিএ পাস করেন।
১৯৫৭ সালে আবু ওসমান ঢাকা এয়ারপোর্টে ‘এয়ারপোর্ট অফিসার’ হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। এই পদের প্রশিক্ষণে থাকাকালীনই তিনি সেনাবাহিনীতে কমিশনের জন্য প্রদত্ত পরীক্ষায় পাস করায় আন্তঃবাহিনী নির্বাচন বোর্ডে উপস্থিত হওয়ারর ডাক পান। ১৯৫৮ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের কোহাটে অবস্থিত অফিসার্স ট্রেনিং স্কুলে (ওটিএস) যোগ দেন। সেখানে ৯ মাসের কঠিন প্রশিক্ষণের পর ১৯৫৮ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশনপ্রাপ্ত হন। ১৯৬৮ সালের এপ্রিল মাসে তিনি মেজর পদে পদোন্নতি লাভ করেন৷
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আবু ওসমান চৌধুরী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন মেজর পদে কুষ্টিয়ায় কর্মরত ছিলেন। অপারেশন সার্চলাইটের সংবাদ পেয়ে ২৬শে মার্চ সকালে বেলা ১১টায় তিনি চুয়াডাঙার ঘাঁটিতে পৌঁছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং মুক্তিযুদ্ধে সসৈন্য যোগ দেন। এর আগে ১৯৭১ সালের ৬ মার্চ আবু ওসমান চৌধুরী পদ্মা মেঘনার ওপারে কুষ্টিয়া থেকে বরিশাল জেলা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকাকে দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গন নামকরণ করে সে রণাঙ্গনের অধিনায়কত্ব গ্রহণ করেন৷
পরে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকার তাকে দক্ষিণ পশ্চিমাংশের আঞ্চলিক কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত করেন৷ মে মাসের শেষার্ধে প্রধান সেনাপতি এম এ জি ওসমানী দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনকে দুই ভাগ করে ৮নং ও ৯নং সেক্টরদ্বয় গঠন করেন এবং ৮ নং সেক্টরের দায়িত্বে আবু ওসমানকে নিয়োগ করা হয়৷ প্রাথমিকভাবে সে সময় ওই সেক্টরের অপারেশন এলাকা ছিল কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা, বরিশাল, ফরিদপুর ও পটুয়াখালী জেলা। মে মাসের শেষে অপারেশন এলাকা সংকুচিত করে কুষ্টিয়া ও যশোর, খুলনা জেলা সদর, সাতক্ষীরা মহকুমা এবং ফরিদপুরের উত্তরাংশ নিয়ে এই এলাকা পুনর্গঠন করা হয়। এই সেক্টরের প্রধান ছিলেন আবু ওসমান চৌধুরী এবং পরে মেজর এম এ মঞ্জুর৷
💥সেক্টর কমান্ডার মেজর ওসমান গাঁথা 💥
১। যুদ্ধের ডায়রী (ওয়ার ডাইরী)তে ভরা থাকে অনেক ঘটনা, অধিকাংশই স্কেচি, রেফারেন্স এর মতো। মূল কথাগুলো থাকে মেমোরীতে। সেক্টর কমান্ডার, মেজর আবু ওসমান চৌধুরী সব কথা লিখে যান নাই। কিন্তু কিছু ঘটনা ভিন্ন আঙ্গিকে লেখা হয়েছে দেশে-বিদেশে। তার সামান্য অংশ তুলে ধরছি। কেন? কারণ, ৮ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর ওসমান এর কিছু কার্যক্রম আমাদের যুদ্ধের ইতিহাসে অনন্য বলে মনে হয়েছে।
💥 ১ম ঘটনাঃ
২। ’৭১ এর যুদ্ধের প্রথম কমান্ডের নামঃ ‘দক্ষিন-পশ্চিম কমান্ড (SOUTH WESTERN COMMAND), কমান্ডের জন্মঃ ২৬ মার্চ ১৯৭১ এর রাতে, চুয়াডাঙ্গায়। এর অধিনায়কঃ মেজর আবু ওসমান চৌধুরী, কমান্ডের প্রধান উপদেষ্টাঃ ডাঃ আসহাবুল হক, এমপিএ, ডেপুটী উপদেষ্টাঃ ব্যারিষ্টার আবু আহমেদ আফাজালুর রশিদ (বাদল রশিদ), এমএনএ, এবং এ্যাডভোকেট ইউনুস আলো, এমপিএ। কমান্ডের সদর দপ্তরঃ চুয়াডাঙ্গার জেলা পরিষদ ডাক-বাংলো।ক্যাপ্টেন এ আর আজম চৌধুরী ছিলেন যোগ্য সহ-অধিনায়ক। ১১ জুলাই ১৯৭১ অফিসিয়ালী সেক্টরের সীমারেখা ঘোষণা পর্যন্ত মেজর আবু ওসমান চৌধুরী SOUTH WESTERN COMMAND এর দায়িত্ব পালন করেন।
💥 ২য় ঘটনা
৩। ২৭ মার্চ ১৯৭১ এর দুপুরে ইপিআর এর উইং ৪ এর সদর দপ্তরে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের পতাকা উঠানো হয়।কোন সামরিক ইনষ্টিটিউশনে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন 🇧🇩বাংলাদেশের🇧🇩পতাকা উত্তোলনের সেটাই ছিলো প্রথম ঘটনা।
💥 ৩য় ঘটনা
৪। যশোর থেকে ২৭ বালুচ রেজিমেন্টের এক কোম্পানী (১৫৫) সেনা নিয়ে মেজর শোয়েব ২৫/২৬ মার্চ ১৯৭১ এ কুষ্টিয়ায় এসে পুলিশ লাইন, ভিএইচএফ ষ্টেশন, ও টেলিফোন এক্সচেঞ্জ এলাকায় অবস্থান গ্রহন করে। মেজর ওসমান ইতিমধ্যে স্থানীয় পুলিশ, আনসার, ও যুবকদের নিয়ে সংগঠিত হয়ে কুষ্টিয়া আক্রমনের সিদ্ধান্ত নেন।কিন্তু আক্রমনের আগেই ২৮ মার্চ ১৯৭১ রাত ৯:৩০ মিনিটে কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার ২৭ বালুচের মেজর শোয়েবকে আসন্ন আক্রমন সম্পর্কে তথ্য দেন। ২৯ মার্চ ’৭১ এর ভোড় ৩:৪৫ মিনিটে ইপিআর এর ৪ উইং কুষ্টিয়া আক্রমন শুরু করে তাদের ৩ ইঞ্চি মর্টারের গোলাবর্ষনের মধ্যে দিয়ে। বালুচ কোম্পানীর ২০টি লাশ রেখে হলে বাকীরা সেখান থেলে পালিয়ে গেলে সকাল ৯:৩০ মিনিটের মধ্যে পুলিশ লাইন মুক্ত হয়।
৫। ২৯ মার্চ ’৭১ এর ভোড় ৩:৪৫ মিনিটে মেজর ওসমানের বাহিনী শহরের ভিএইচএফ ষ্টেশন ও টেলিফোন এক্সচেঞ্জ একই সাথে আক্রমন করে। সেখানে ২৫ জন পাকিস্তানী সেনার মৃত্যূ হলে মেজর শোয়েব যশোরে মেসেজ পাঠায় অতিরিক্ত সেনা পাঠানো ও বিমান আক্রমণের সহায়তা চেয়ে। যশোর থেকে মেজর শোয়েবের কাছে উত্তর এসেছিলোঃ “Troops here already committed. No reinforcement possible. Air strike called-off due to poor visibility, Khuda Hafiz” (বাংলাঃ সব সেনা মোতায়েন করা হয়েছে, পাঠানোর মত কেউ অবশিষ্ট নেই। খারাপ আবহাওয়ার জন্য বিমান আক্রমন বাতিল করা হয়েছে। খোদা হাফেজ)
৬। মেজর শোয়েব’ এর কোম্পানীর(১৫৫ জন)অবশিষ্ট মাত্র ৬৫ জন জীবিত ছিলো। ৯০টি লাশ কুষ্টিয়া শহরে ফেলে ২৯ মার্চ দিবাগত রাতে ৬টি জীপ, একটি ডজ (পিক-আপ) ও ১ট ৩টন ট্রাক নিয়ে কু শষ্টী শজটিয়া ষ্টয়া ত্যাক করে, উদ্দেশ্যঃ কোনভাবে যশোর পৌছানো। লিড জীপে মেজর শোয়েব। হেড-লাইট নিভিয়ে চলতে যেয়ে পথিমধ্যে কুষ্টিয়া থেকে ২৫ কিঃমিঃ দূরে রাস্তার ভেঙ্গে ফেলা এক কালভার্টে মেজর শোয়েবের জীপ পড়ে গেলেই শুরু হয় দুই পাশ থেকে বৃষ্টির মতো গুলী। মেজর আবু ওসমানের দলের বৃষ্টি ঝড়া গুলীতে ৬৫ জন সেনার মধ্যে বেঁচে থাকা মাত্র ৯ জন ক্রলিং করে রাতের অন্ধকারে পাশের গ্রামে ঢুকে পড়লে সেখানেই তাদের হত্যা করা হয়।শেষ হয়ে যায় পাকিস্তান বাহিনীর ২৭ বালুচ রেজিমেন্টের একটি কোম্পানী। পাকিস্তানে বালুচ রেজিমেন্টাল সেন্টারে রয়েছে এই ১৫৫ জন সেনার স্মৃতি ফলক।
💥 শেষ কথা
৭। উপরের ঘটনাক্রম স্বাধীনতা যুদ্ধে মেজর আবু ওসমান চৌধুরী’র প্রাথমিক দিনের ঘটনাক্রম। কুষ্টিয়া দখল করে ট্রেজারী থেকে আনুমানিক ৪০/৫০ কেজি(!) সোনা এবং প্রায় ৪ লক্ষ(!) টাকা নুতন সরকারের কাছে হস্তান্তর করেন, যা যুদ্ধের সেই প্রাথমিক দিনগুলোতে ছিলো সরকারের একমাত্র সম্বল। এই মহান মানুষটি আগষ্ট ১৯৭১ পর্যন্ত এই সেক্টরের অধিনায়ক ছিলেন।
REFERENCES:
A. Abu Osman Chowdhury, Military, military.wikia.org/wiki/Abu_Osman_Chowdhury
B. “Confer Bir Uttam award on Abu Osman Chowdhury”, M. Emad, Oxford, UK, The Daily Star, 12:00 AM, December 14, 2012 / LAST MODIFIED: 12:00 AM, December 14, 2012
C. ‘Witness to Surrender’, Page 83~85, Siddiq Salik
D. Pictures Collected from @Aminul Sarwar
Courtesy : Shanto Rahman
Discussion about this post