স্বাধীনতার ৪৯ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো জানা যায়নি মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক সংখ্যা। ক্ষমতা আর সময়ের পরিবর্তনের সাথে বারবার পরিবর্তন হয়েছে তালিকা। এ কারণে আজও প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি কাটেনি। দেশে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা কত? এ প্রশ্নের জবাব দিতে পারেননি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী ও সচিব।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, যাচাই-বাছাই চলার কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত সংখ্যা এখনো বলা কঠিন। তবে ভাতাপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৯২ হাজার। কিন্তু সফটওয়্যারের মাধ্যমে ভাতা প্রদানের ক্ষেত্রে আরো ২০ হাজার মুক্তিযোদ্ধা বাদ পড়ে গেছে। কারণ জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্মনিবন্ধন ও ভোটার আইডি কার্ডের সঙ্গে নামের বানানসহ জন্ম তারিখ মিল না হওয়ায় এই সমস্যা তৈরি হয়েছে। তারপরও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত সংখ্যা নির্ধারণের জন্য কাজ করা হচ্ছে।
স্বাধীনতা পরবর্তী ৪৯ বছরে ছয়বার মুক্তিযোদ্ধা তালিকা সংযোজন-বিয়োজন হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধার বয়স, সংজ্ঞা ও মানদণ্ড পাল্টেছে ১১ বার। সেনাবাহিনীর সংরক্ষিত দলিলের তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর কয়েকজন সেক্টর কমান্ডার ও সাব-সেক্টর কমান্ডারদের প্রকাশিত বইয়ে নিয়মিত বাহিনীর ২৪ হাজার ৮০০ এবং অনিয়মিত বাহিনীর ১ লাখ ৭ হাজারসহ মোট ১ লাখ ৩১ হাজার ৮০০ জনকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য করা হয়। ১৯৯৮ সালের আগ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের চার-পাঁচটি তালিকা প্রণয়নের উদ্যোগ নিলেও তা চূড়ান্ত রূপ পায়নি।
মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমিন আহমেদ চৌধুরী বিভিন্ন সেক্টরের তথ্য নিয়ে একটি তালিকা ভলিউম আকারে প্রকাশ করেন, যাতে ৭০ হাজার ৮৯৬ জন মুক্তিযোদ্ধাকে তালিকাভুক্ত করা হয়। বাকি ৬০ হাজার ৯০৪ জন কোন তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবেন তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। ১৯৯৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে তার কার্যালয়ের তৎকালীন মহাপরিচালক মমিনউল্লাহ পাটোয়ারীর মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ প্রথমবারের মতো একটি তালিকা করে। ওই তালিকাটি মুক্তিযোদ্ধা সংসদে ‘লাল বই’ নামে সংরক্ষিত রয়েছে। বর্তমানে এই তালিকায় ১ লাখ ৫৪ হাজার জনের নাম থাকলেও সবার নামে গেজেট প্রকাশিত হয়নি। এই ‘লাল বই’য়ে আমিন আহমেদের তালিকার বেশিরভাগের নাম অন্তর্ভুক্ত হলেও কিছু নাম বাদ পড়েছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিগত চারদলীয় জোট সরকার মুক্তিযোদ্ধা সংসদকে দায়িত্ব না দিয়ে তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিব সা’দত হুসাইনের নেতৃত্বে চারজন সচিব ও খেতাবধারী মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে একটি জাতীয় কমিটি করে। ওই কমিটির দায়িত্ব ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা তৈরি করে সরকারকে সুপারিশ করা, যাদের নাম গেজেট আকারে প্রকাশ করা হবে। ওই জাতীয় কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ২০০২ সালের ৪ মার্চ সশস্ত্র বাহিনীর ৩৯ হাজার মুক্তিযোদ্ধার নামে ‘বিশেষ গেজেট’ এবং ১ লাখ ৫৯ হাজার মুক্তিযোদ্ধার নামে ‘গেজেট’ প্রকাশ করা হয়। বিএনপি সরকার নতুন করে আরো ৪৪ হাজার জনকে মুক্তিযোদ্ধার সনদ দিয়ে মোট ১ লাখ ৯৮ হাজার জনের নামে গেজেট প্রকাশ করে। চারদলীয় জোট আমলে ৭২ হাজার ‘ভুয়া’ ব্যক্তিকে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় সন্নিবেশিত করা হয় বলে জাতীয় সংসদে অভিযোগ তোলেন তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী এবি তাজুল ইসলাম। এরপর ২০০৯ সালের ১৩ মে তালিকা যাচাই-বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত নেয় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। তাজুল ইসলামও ডেপুটি কমিশনার ও ইউএনওদের নিয়ে কমিটি করে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা যাচাই-বাছাইয়ের দায়িত্ব দেন। মুক্তিযোদ্ধা সংসদকে তালিকা তৈরি করে ডিসি-ইউএনওদের কাছে দেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়। ডিসি-ইউএনওদের নেতৃত্বের কমিটি দুই বছরেও তালিকা যাচাইয়ের কাজ শেষ করতে না পারায় মন্ত্রণালয় এবং এ সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির হস্তক্ষেপে প্রশ্নবিদ্ধ ৬২ হাজার জনের তালিকা এবং নতুন করে আরো ১ লাখ ৪৫ হাজার জনের নাম অন্তর্ভুক্তির তালিকা যাচাই-বাছাইয়ের দায়িত্ব দেয়া হয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদকে। কিন্তু ওই সময়কার মুক্তিযোদ্ধা সংসদের মেয়াদ শেষ পর্যায়ে থাকায় এ যাচাই-বাছাইয়ের কাজ আর এগোয়নি বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
আওয়ামী লীগ সরকার ২০১০-২০১২ সালে আরও ১১ হাজার জনকে মুক্তিযোদ্ধার সনদ দিয়ে মোট দুই লাখ নয় হাজার জনের নাম তালিকাভুক্ত করে। পাশাপাশি কয়েকজন সচিবের সঙ্গে কয়েকশ সরকারি কর্মকর্তা এবং মুক্তিযোদ্ধা সনদধারীর গেজেট বাতিল করে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। পরে নতুন সংজ্ঞার আলোকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভুক্ত হওয়ার জন্য জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের ওয়েবসাইটে অনলাইনে আবেদন নেয়া হয়। বিএনপি সরকারের সময় নতুন করে তালিকাভুক্ত ৪৪ হাজারের বেশিরভাগ এবং বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় তালিকাভুক্ত ১১ হাজারের অর্ধেকই ‘ভুয়া’ বলে শনাক্ত করা হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে বেশ কয়েক বছরজুড়ে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা যাচাই-বাছাইয়ের কাজটি চললেও পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়নের কাজ নানা কারণে আর শেষ করা যায়নি বলে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান।
এদিকে দেশে এখনো অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা আছেন যারা তালিকাভুক্তি হয়নি। পাননি সরকারি সুযোগ-সুবিধা। তাই বিভিন্ন যাচাই-বাছাইয়ের জটিলতায় হারিয়ে যাচ্ছে প্রকৃত মৃক্তিযোদ্ধারা। বরিশাল জেলার মুলাদী থানার নাজিরপুর গ্রামের ৭ জন মুক্তিযোদ্ধা ভারতীয় তালিকায় নাম থাকার পর এখনো সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এদের প্রত্যেকের বয়স ৬০-৭০ বছরের বেশি হবে। এদের মধ্যে দুইজন মুক্তিযোদ্ধা মারা গেছেন। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেখে যেতে পারেননি।
এ বিষয়ে নাজিরপুরের হাওলাদার বাড়ির বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু বকর বলেন, বরিশালের ৯ নম্বর সেক্টরে আমরা যুদ্ধ করেছি। ভারতের টাকী ক্যাপে ট্রেনিং নিয়েছি। ভারতীয় তালিকায় ১০০৮ নাম্বারে আমার নাম রয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ ১০-১৫ বছর যাবত মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি জন্য আমরা চেষ্টা করছি। নাজিরপুরে আমাদের সাতজনের নাম ভারতীয় তালিকায় রয়েছে। এখনও আমরা সরকারি ভাতা প্রাপ্তিসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছি না। আমাদের সাতজনের মধ্যে ইতিমধ্যে নেছার উদ্দীন ও হোসেন মীরা নামের দুইজন মারা গেছেন। আমরাও বেশিদিন বাঁচবো না। মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেখে যেতে পারলে মরে শান্তি পেতাম।
বরিশালের আবু বকর হাওলাদারের মতো এ রকম আরো অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা আছেন। যারা এখনও তালিকাভুক্তি হয়নি। অনেক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্তি হয়েছেন যুদ্ধের সময় যাদের বয়স ছিল ৯ বছর। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এসে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নবায়নের প্রকল্প নেয়। কিন্তু দীর্ঘদিন পরেও মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা চূড়ান্ত করা হয়নি। সর্বশেষ বর্তমান সরকার চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা প্রণয়নের জন্য উপজেলাভিত্তিক কমিটি গঠন করে খসড়া তালিকা তৈরি করে। কিন্তু যাচাই-বাছাই কমিটি ও তালিকা নিয়ে অভিযোগ করে আদালতে মামলা করেন মুক্তিযোদ্ধরা। আদালতে শতাধিক মামলা থাকার কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা এখনও চূড়ান্ত করা যায়নি বলে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়।
এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, আগামী সপ্তাহের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি প্রাথমিক তালিকা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে। কোন না কোন তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন- এমন সব নাম মিলিয়ে দেশে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়ায় ৩ লাখ ৩৩ হাজার ৮৫৬ জন। কিন্তু স্বীকৃতির দাবি করেছেন এমন মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ২ লাখ ৫১ হাজার ২৮৫ জন। একজনের নাম একাধিক দলিলে থাকায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বেশি মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে ওই সংখ্যা ১ লাখ ৭০ হাজারের বেশি হবে না।
মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অন্তর্ভুক্তির জন্য নতুন করে যে ১ লাখ ২৩ হাজার আবেদন জমা পড়েছিল, তার মধ্যে খুলনা বিভাগ বাদে অন্যান্য এলাকার আবেদনগুলো যাচাই-বাছাই শেষ করেছে সরকার। তবে এর আগে বীর মুক্তিযোদ্ধা বিবেচিত হয়ে বেসামরিক গেজেট পেলেও ভালো কোন রেকর্ড নেই- এমন সাড়ে ৪৩ হাজারের তালিকা নতুন করে যাচাই-বাছাই হচ্ছে। আগামী ৯ জানুয়ারি ডেপুটি কমিশনার (ডিসি) এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয়ে এই যাচাই-বাছাইয়ের কাজটি হবে। গত ২ জুন নতুন করে ১ হাজার ২৫৬ জনকে বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ করে সরকার। তাদের নিয়ে স্বীকৃতি পাওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৩ হাজার ৫৬ জন। তবে যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকায় এটাকে ‘প্রকৃত সংখ্যা’ বলা যাচ্ছে না। খুলনা বিভাগের নতুন আবেদন যাচাই-বছাই এবং সাড়ে ৪৩ হাজার জনের গেজেট যাচাই-বাছাই শেষ না হওয়ায় এখন বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত সংখ্যা বলা যাচ্ছে না। সাড়ে ৪৩ হাজার গেজেট যাচাই-বাছাই শেষ হলেও মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক সংখ্যা জানতে আরো সময় লাগতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান।
Discussion about this post