দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ২৪ ফেব্রুয়ারি: জামায়াতের আমীর মতিউর রহমান নিজামীকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদন্ডের রায়ের বিষয়ে আনা আপিলে রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষকে আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে আপিলের সারসংক্ষেপ দাখিল করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।মঙ্গলবার প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের চার বিচারপতির বেঞ্চ এ আদেশ দেয়। বেঞ্চের অন্য সদস্যরা হচ্ছেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।নিজামীর আইনজীবী শিশির মোহাম্মদ মনির সাংবাদিকদের বলেন, উভয়পক্ষকে দুই সপ্তাহের মধ্যে আপিলের সারসংক্ষেপ দাখিল করতে বলেছে আপিল বিভাগ।আপিল মামলাটি আজ আদালতের কার্যতালিকার ৩ নম্বরে ছিল। পরে আদালত আপিলের সারসংক্ষেপ জমা দেয়ার জন্য উভয়পক্ষকে আদেশ দেয়।
নিজামীকে মৃত্যুদন্ড দিয়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে গতবছর ২৩ নভেম্বর আপিল দায়ের করা হয়েছিল। ৬ হাজার ২৫২ পৃষ্ঠার ডকুমেন্ট পেশ করে তাতে ১৬৮টি কারণ উল্লেখ করে দন্ড থেকে খালাস চেয়ে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড জয়নুল আবেদীন তুহিন এ আপিলটি দাখিল করেন।নিজামীর পক্ষের আইনজীবী তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, ১২১ পৃষ্ঠায় মূল আপিল আবেদনের সঙ্গে ৬ হাজার ২৫২ পৃষ্ঠার নথিপত্র দাখিল করা হয়েছে। মূল আপিলে ১৬৮ টি গ্রাউন্ড পেশ করে দন্ড থেকে খালাস চাওয়া হয়েছে।
এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ট্রাইব্যুনাল নিজামীর সর্বোচ্চ সাজার যে রায় দিয়েছে, তাতে রাষ্ট্রপক্ষ সন্তুষ্ট। আসামির আপিলের বিপরীতে শুনানিতে অংশ নেবে রাষ্ট্রপক্ষ। ট্রাইব্যুনালে দেয়া দন্ডের পক্ষে বক্তব্য উপস্থাপন করে তা বহাল রাখতে আর্জি পেশ করবে রাষ্ট্রপক্ষ।নিজামীকে মৃত্যুদন্ড দিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার গতবছর ২৯ অক্টোবর রায় ঘোষণা করে ট্রাইব্যুনাল। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১এর চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল জনাকীর্ণ ট্রাইব্যুনালে এ রায় ঘোষণা করে। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি আনোয়ারুল হক।
রায়ে বলা হয়, নিজামীর বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন আনীত ১৬টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগের মধ্যে ৮টি অভিযোগ সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণিত হয়েছে। ১, ২, ৩, ৪, ৬, ৭, ৮ ও ১৬ নম্বর অভিযোগ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে প্রসিকিউশন। এর মধ্যে ২, ৪, ৬ ও ১৬ নম্বর অভিযোগে নিজামীকে ফাঁসির (মৃত্যুদন্ড) আদেশ দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল। ১, ৩,৭ ও ৮ নম্বর অভিযোগে তাকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়া হয়েছে। এছাড়া ৫, ৯, ১০ থেকে ১৫ নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় এসব অভিযোগ থেকে তাকে অব্যাহতি (খালাস) দেয়া হয়।
যে সব অভিযোগে তাকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়-সে অভিযোগগুলো হলো: অভিযোগ-২. একাত্তর সালের ২২ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক একাডেমী হলে নিজামী বক্তৃতা করেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকদের ইসলামের শত্রু হিসেবে আখ্যা দিয়ে তাদের নিশ্চিহ্ন করতে প্ররোচণা দেন। অভিযোগ-৪. একাত্তরের ৯ ও ১০ সেপ্টেম্বর যশোর বিডিহলে আয়োজিত এক সভায় স্বাধীনতাকামী বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীকে নির্মূলে তার সহযোগীদের প্রতি আহবান জানান। অভিযোগ-৬. একাত্তরের ৮ মে সাথিয়ায় সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূজাঘরের সামনে নিজামীর পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্তে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনকে হত্যা, নারীদের ধর্ষণ, লুন্ঠন ও বাড়ীতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা সংঘটিত হয়। অভিযোগ-১৬. মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের দ্বারপ্রান্ত একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যার সঙ্গে নিজামী জড়িত থাকার ঘটনা।
যে সব অভিযোগে নিজামীকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়া হয়-তা হলো: অভিযোগ-১. নিজামী জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ছাত্রসংঘের সভাপতি হিসেবে ১৯৭১ সালের ৩ আগস্ট চট্টগ্রাম মুসলিম হল ইন্সটিটিউটে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে উস্কানীমূলক বক্তব্য দেন। এ বক্তব্যে তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকদের নিমূর্ল করতে তার সহযোগীদের আহবান জানান।অভিযোগ- ৩.একাত্তরের ৮ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন প্রাঙ্গণে দেয়া এক বক্তৃতায় স্বাধীনতার পক্ষের লোকদের ভারতের দালাল উল্লেখ করে তাদের নির্মূলের আহবান জানান নিজামী।
অভিযোগ-৭. একাত্তরের ২৭ নভেম্বর পাবনার সাঁথিয়া থানার ধুলাউড়ি গ্রামে আব্দুল আওয়ালের বাড়ী ঘেরাও করে ৩০ জনকে হত্যা, বাড়ীতে লুট, নারীদের ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগ।অভিযোগ-৮. ১৬ এপ্রিল পাবনার ঈশ্বরদী থানার আর পাড়া ও ভুতের গাড়ী গ্রামের বিভিন্ন বাড়ীতে লুট, অগ্নিসংযোগ ও নিরিহ হাফেজ ওমর আলীসহ ১৯ জনকে হত্যা।
রায়ে বলা হয়, জামায়াতের আজকের আমীর নিজামী চারদশক আগে ছিলেন জামায়াতেরই ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের প্রধান এবং সেই সূত্রে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতার জন্য গঠিত আলবদর বাহিনীরও নেতা। তার নেতৃত্বে ও প্ররোচণায় মানবাধিকারের চরম লংঘন, স্বাধীনতাকামীদের দমন-পীড়ন, গনণহত্যা, দেশের মেধাবী নাগরিক বুদ্ধিজীবী হত্যাসহ আনীত অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে।নিজামীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, লুট, ধর্ষণ, উস্কানি ও সহায়তা, পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র এবং বুদ্ধিজীবী হত্যার মতো ১৬টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। এসব ঘটনায় অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে ২০১২ সালের ২৮ মে তার বিচার শুরু হয়।
নিজামীর মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ট্রাইব্যুনালের আদেশে ৪ জন সাফাই সাক্ষী সাক্ষ্য দেয়। সাক্ষিদের জেরা করে প্রসিকিউশন। নিজামীর বিরুদ্ধে গত বছরের ২৬ আগস্ট থেকে ৮ অক্টোবর পর্যন্ত সাক্ষী হিসেবে মুক্তিযোদ্ধা, অধ্যাপক, সাংবাদিক ও ইতিহাসবিদসহ মোট ২৬ সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন। আসামীপক্ষ এসব সাক্ষিদের জেরা করেছে।
একটি মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুন মতিউর রহমান নিজামীকে গ্রেফতার করা হয়। পরে একই বছরের ২ আগস্ট এক আবেদনের প্রেক্ষিতে ট্রাইব্যুনালের আদেশে তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায গ্রেফতার দেখানো হয়। সে থেকে তিনি কারাগারে রয়েছেন।