দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ১৫ আগস্ট, ২০১৫: বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের আগে পরে গোয়েন্দারা মরদেহগুলোর ছবি তোলা ছাড়া, আর সেনাবাহিনীর মূল ধারা দাফনের ব্যবস্থা করা ছাড়া আর কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। সেনাপ্রধান যখন নিজের বাসভবন আর অফিসে ছুটোছুটি করছেন, উপ-প্রধান শেভ করছেন আর ব্রিগেড কমান্ডার কিংকর্তব্যবিমূঢ়; তখন ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে সব শেষ। শেখ কামালকে হত্যার মধ্য দিয়ে হত্যাযজ্ঞের শুরু, আর শেষ শিশু শেখ রাসেলকে হত্যার মধ্য দিয়ে।
হত্যা মামলার সাক্ষীদের সাক্ষ্যে ওই সকালের নারকীয় এক হত্যাযজ্ঞের চিত্র ফুটে উঠেছে। খুনিদের নির্মমতার যে চিত্র তাদের বর্ণনায় পাওয়া যায়, তার নজির ইতিহাসে আর নেই। বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের যখন ‘পানি পানি’ বলে চীৎকার করছিলেন; তখন আরেক দফা গুলি করে তাকে স্তব্ধ করে দেওয়া হয়। আর দশ বছরের শিশু রাসেলকে হত্যা করা হয় মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে। দোতলায় হত্যাযজ্ঞ শেষে রাসেল এবং বাড়ির কাজের ছেলে আব্দুর রহমান রমাকে যখন নীচে নিয়ে আসা হয় তখন রাসেল এরইমধ্যে হাঁটুতে গুলিবিদ্ধ মুহিতুল ইসলামকে বলেছিলো: ভাইয়া, আমাকে মারবে না তো? এরকম শিশুকেও নিশ্চয়ই খুনিরা মারবে না আশায় মুহিতুল ইসলাম তাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন: না, ভাইয়া, তোমাকে মারবে না।
বঙ্গবন্ধুর রেসিডেন্ট পি.এ এবং মামলার বাদী ও এক নম্বর সাক্ষী মুহিতুল ইসলাম আরো জানান, এরপর একজন আর্মি তার কাছ থেকে রাসেলকে জোর করে ছাড়িয়ে নিয়ে যায়। মুহিতুল ইসলাম ছাড়াও মামলার দুই নম্বর সাক্ষী রমা, তিন নম্বর সাক্ষী মশালচি সেলিম ওরফে আব্দুল এবং চার নম্বর সাক্ষী হাবিলদার কুদ্দুস শিশু রাসেলকে হত্যার মর্মস্পর্শী বর্ণনা দিয়েছেন। হাবিলদার কুদ্দুস জানান: মেজর আজিজ পাশা অয়্যারলেসে কথা বলছিলো। তখন রাসেল মায়ের কাছে যাবে বলে কান্নাকাটি করছিলো। মেজর আজিজ পাশা ল্যান্সারের একজন হাবিলদারকে নির্দেশ দিয়ে বলে, শেখ রাসেলকে তার মায়ের কাছে নিয়ে যাও।
‘ওই হাবিলদার শেখ রাসেলকে তার হাত ধরে দোতলায় নিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর দোতলায় গুলি এবং সেখান থেকে কান্নাকাটির আওয়াজ পাওয়া যায়। আর ওই হাবিলদার নীচে গেটের কাছে এসে মেজর আজিজ পাশাকে বলে: স্যার, সব শেষ।’ এভাবেই রাসেলকে হত্যার বর্ণনা দেন সাক্ষী কুদ্দুস। এর আগে আজিজ পাশা এবং রিসালদার মোসলেমউদ্দিন বঙ্গবন্ধুর বেডরুমে বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব, শেখ জামাল, শেখ জামালের স্ত্রী এবং শেখ কামালের স্ত্রীকে হত্যা করে বলে ওই সাক্ষী জানান। মুহিতুল ইসলাম, রমা, মশালচি সেলিম, হাবিলদার কুদ্দুস, সুবেদার গণি এবং হাবিলদার সোহরাব আলীসহ সাক্ষীদের বক্তব্যে জানা যায়, ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে সেদিন হত্যাকাণ্ডের শুরু শেখ কামালকে হত্যার মধ্য দিয়ে। প্রথম দফা আক্রমণের পর প্রেসিডেন্টের সহায়তায় সেনাবাহিনী এসেছে আশা করে শেখ কামাল সেনা দলকে ভেতরে ডাকার পরই ক্যাপ্টেন হুদা তাকে গুলি করে। শেখ কামাল নিজের পরিচয় দিলে তার উপর ব্রাশফায়ার করে হুদা।
এর আগেই মিন্টো রোডের মন্ত্রিপাড়ায় আব্দুর সেরনিয়াবাতের বাড়িতে হামলার খবরে ঘুম ভাঙে বঙ্গবন্ধু পরিবারের সব সদস্যের। তার বর্ণনা দিয়েছেন ঊনসত্তর সাল থেকে ওই পরিবারে কাজ করা, একাত্তরেও ওই পরিবারের সঙ্গে থাকা মামলার দ্বিতীয় সাক্ষী আব্দুর রহমান রমা। তিনি জানান: আনুমানিক ভোর ৫টার দিকে হঠাৎ বেগম মুজিব দরোজা খুলে বাইরে এসে বলেন, দুস্কৃতকারীরা সেরনিয়াবাতের বাসা আক্রমণ করেছে। দ্রুত লেকের পাড়ে গিয়ে দেখি কিছু আর্মি গুলি করতে করতে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে আসছে। বঙ্গবন্ধুকে তখন পি.এ এবং রিসেপশনিস্টের রুমে কথা বলতে দেখি। দোতলায় উঠে দেখি বেগম মুজিব ছোটাছুটি করছেন। তিন তলায় গিয়ে আর্মিরা বাসা আক্রমণ করেছে বলে শেখ কামালকে ঘুম থেকে উঠাই। কামাল দ্রুত একটা শার্ট এবং প্যান্ট পরে নীচের দিকে চলে যান। তার স্ত্রী সুলতানা কামাল দোতলায় আসেন। দোতলায় একইভাবে শেখ জামালকে ঘুম থেকে উঠাই। শেখ জামালও দ্রুত শার্ট-প্যান্ট পরে মায়ের রুমে যান, সঙ্গে তার স্ত্রীও ছিলেন। তখন খুব গুলি হচ্ছিলো। এই পর্যায়ে শেখ কামালের আর্তচীৎকার শুনতে পাই।
এর আগেই বঙ্গবন্ধু নীচে নেমে আবার দোতলায় চলে এসেছিলেন। গুলি থামলে তিনি তার রুম থেকে বের হওয়ামাত্র আর্মিরা তাকে তার বেডরুমের সামনে ঘিরেফেলে। রমা জানান: বঙ্গবন্ধু তাদের বলেন, তোরা কি চাস? কোথায় নিয়া যাবি আমাকে? তারা তখন বঙ্গবন্ধুকে সিঁড়ির দিকে নিয়ে যাচ্ছিলো। দুই/তিন ধাপ নামার পর নীচের দিক থেকে আর্মিরা গুলি করে। বঙ্গবন্ধুকে সিঁড়ির দিকে নিয়ে যাবার সময় তিনি আহত অবস্থায় মশালচি সেলিম ওরফে আব্দুলকে আহত এবং রক্তাক্ত অবস্থায় দেখে সেনা সদস্যদের বলেন, এই ছেলেটা ছোটবেলা থেকে আমাদের এখানে থাকে, একে কে গুলি করলো?
সেলিম জানান: ওই সময়েও তার ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু সেনা সদস্যদের বলেন, তোরা আমাকে কোথায় নিয়া যাবি? কি বলবি? বেয়াদবি করছ ক্যান? এর কিছুক্ষণ পরই সিঁড়ির দিক থেকে বঙ্গবন্ধুর ওপর গুলি। বঙ্গবন্ধুকে গুলি করা সেনা কর্মকর্তাদের পরিচয় জানিয়েছেন মামলার চার নম্বর সাক্ষী এবং নিরাপত্তারক্ষী হাবিলদার কুদ্দুস। তিনি বলেছেন: মেজর মুহিউদ্দিন তার ল্যান্সারের ফোর্স নিয়ে গুলি করতে করতে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের দোতলার দিকে যায়। পরে কয়েকজন ফোর্স নিয়ে দোতলার দিকে যায় ক্যাপ্টেন হুদা ও মেজর নূর। যাবার সময় তাদেরকেও পেছন পেছন যেতে হুকুম দেয়।
তিনি জানান: ক্যাপ্টেন হুদা এবং মেজর নূর যখন সিঁড়ির চৌকির ওপরে, তখন আগেই দোতলায় যাওয়া মেজর মুহিউদ্দিন ও তার ফোর্স বঙ্গবন্ধুকে নিচের দিকে নামিয়ে আনছিলো। মেজর নূর ইংরেজিতে কিছু বললে মেজর মুহিউদ্দিন এবং তার ফোর্স একপাশে চলে যায়। এই সময় বঙ্গবন্ধু বলেন, তোরা কি চাস? সঙ্গে সঙ্গে ক্যাপ্টেন হুদা এবং মেজর নূর স্টেনগান দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে গুলি করে। সিঁড়ির ওপর লুটিয়ে পড়েন বঙ্গবন্ধু, সেসময়ই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। শুধু জাতির জনক নন, সেদিন আসলে পুরো জাতিই লুটিয়ে পড়েছিলো।
আব্দুর রহমান রমা জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে কলংকজনক এ হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করেন। সেসময় আর্মিরা তার পরিচয় পেয়ে তাকে ভেতরে যেতে বলে। তিনি বেগম মুজিবের বাথরুমে আশ্রয় নেন। বেগম মুজিবকে তখন তাঁর জীবনের সবচেয়ে দুঃখজনক খবরটি জানিয়ে রমা বলেন, বঙ্গবন্ধুকে গুলি করেছে। ওই বাথরুমে শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল, শেখ জামাল ও তার স্ত্রী রোজি, শেখ রাসেল, বেগম মুজিব এবং বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসেরও ছিলেন। সেখানে আশ্রয় নেওয়ার আগেই শেখ নাসেরের হাতে গুলি লাগে। তার হাত থেকে তখন রক্ত ঝরছিলো। ‘বেগম মুজিব তার শাড়ির আঁচল ছিঁড়ে রক্ত মুছে দেন,’ বলে জানিয়েছেন রমা।
এরইমধ্যে অবশ্য ঘাতকদের মনে করিয়ে দেওয়া হয়, পুরো পরিবারকেই মেরে ফেলতে হবে। ঘাতকরা তখন আবার দোতলায় আসে। তারা দরোজায় আঘাত করতে থাকলে বেগম মুজিব ‘মরলে সবাই একসাথেই মরবো’ বলে দরোজা খুলে দেন বলে সেখানে আশ্রয় নেওয়া রমা জানিয়েছেন। রমা বলেন: বেগম মুজিব দরোজা খুললে আর্মিরা রুমের ভেতর ঢুকে শেখ নাসের, শেখ রাসেল, বেগম মুজিব এবং তাকে নীচের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলো। সিঁড়িতে বঙ্গবন্ধুর লাশ দেখে বেগম মুজিব বলেন, আমি নামবো না। আমাকে এখানেই মেরে ফেলো। এমন কথার সঙ্গে বেগম মুজিব কান্নায়ও ভেঙ্গে পড়েন বলে জানান আরেক সাক্ষী হাবিলদার কুদ্দুস। সেনা সদস্যরা তখন বেগম মুজিবকে আবার দোতলার রুমের দিকে নিয়ে যায়। সেখানে সুলতানা কামাল ও রোজি জামাল ছাড়াও শেখ জামাল ছিলেন। একটু পর সেখান থেকে গুলির শব্দ পাওয়া যায়, সঙ্গে আর্তচীৎকার।
ওই রুমে হত্যাকাণ্ড চলার সময় অন্য ঘাতকরা শেখ নাসের, শেখ রাসেল এবং রমাকে নিয়ে নীচে নামে। গুলিতে আহত মশালচি সেলিম ওরফে আব্দুলকেও নীচে নামিয়ে আনা হয়। নীচে নেমে রমা সাদা পোষাকের একজন পুলিশ সদস্যের লাশ দেখেন। তিনি স্পেশাল ব্রাঞ্চের সাব ইন্সপেক্টর সিদ্দিকুর রহমান। মুহিতুল ইসলাম জানিয়েছেন, শেখ কামালকে ব্রাশ ফায়ার করা হলে এস.আই সিদ্দিকুর রহমান এবং ডিএসপি নুরুল ইসলামের (তিনিও মামলার সাক্ষী) শরীরে গুলি লাগে। ওই দু’জন এবং আরেকজন পুলিশ অফিসার পেছনের দরোজা দিয়ে বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করলে মেজর হুদা তাদের চুল ধরে টেনে তুলে এবং গেটের সামনে লাইনে দাঁড় করায়। পুলিশের লোক ছাড়াও টেলিফোন মিস্ত্রি আব্দুল মতিনও ওই লাইনে ছিলেন। হঠাৎ একজন অস্ত্রধারী আর্মি এসে স্পেশাল ব্রাঞ্চের অফিসারকে গুলি করে। গুলিতে তিনি মারা যান। কয়েকজন সেনাসদস্যকে তাদের পাহারায় রেখে ওই দলটি গুলি করতে করতে উপরে চলে যায়।
এই দলটিসহ অন্যরা উপরে হত্যাযজ্ঞ শেষ করে বেঁচে থাকা শেষ ক’জনসহ নীচে নেমে আসে। তখনো বেঁচে থাকাদের মধ্যে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের এবং ছোট ছেলে শেখ রাসেল। রমা জানান, সেনা সদস্যরা শেখ নাসের, শেখ রাসেল এবং তাকে নীচে এনে লাইনে দাঁড় করায়। শেখ নাসেরকে জিগগেশ করে তুমি কে? শেখ নাসের তার পরিচয় দিলে নীচতলার বাথরুমে নিয়ে যায়। একটুপর ওই বাথরুমে গুলি এবং সেখান থেকে ‘মাগো’ বলে চীৎকার শুনতে পান রমা। আরেকটু বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে মুহিতুল ইসলাম জানান: শেখ নাসেরকে যখন লাইনে দাঁড় করানো হয় তখন তার হাত গুলিতে রক্তাক্ত জখম ছিলো। শেখ নাসের বলেন, স্যার, আমি তো রাজনীতি করি না। কোনোরকমে ব্যবসা করে খাই। তখন একজন সেনা কর্মকর্তা বলে, শেখ মুজিব ইজ বেটার দ্যান শেখ নাসের।
‘আর যে অস্ত্রধারী আর্মি শেখ নাসেরকে নীচে নামিয়ে এনেছিলো, সে বলে, ঠিক আছে। আপনাকে কিছু বলবো না। আপনি ওই কক্ষে গিয়ে বসেন। এই বলে অফিসকক্ষ সংলগ্ন বাথরুমে নিয়ে শেখ নাসেরকে গুলি করে। শেখ নাসের পানি পানি বলে চীৎকার করতে থাকলে আর্মিদের একজন পাহারারত আরেকজনকে বলে, যা, পানি দিয়া আয়। সে গিয়ে পানির পরিবর্তে আবারো শেখ নাসেরকে গুলি করে,’ বলে জানান মুহিতুল ইসলাম।
এরপর মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে শিশু রাসেলকেও হত্যা করা হয়। এভাবে সেনাপ্রধান, উপ-সেনাপ্রধান, সিজিএস এবং ব্রিগেড কমান্ডারসহ অন্যদের তখন পর্যন্ত নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ চেষ্টার মধ্যেই ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর পরিবারের সকলকে কোনোরকম বাধা ছাড়াই হত্যা করে সেনাবাহিনীর ল্যান্সার এবং আর্টিলারির একটি অংশ।
Discussion about this post