মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় নেত্রকোনার রাজাকার মো. ওবায়দুল হক তাহের ও আতাউর রহমান ননীকে মৃত্যুদন্ড দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।মঙ্গলবার রায় ঘোষণার পর মামলার প্রসিকিউটর মোখলেসুর রহমান বাদল সাংবাদিকদের বলেন, আসামিদের বিরুদ্ধে আনীত ৬টি অভিযোগের মধ্যে ৪টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণে প্রসিকিউশন সক্ষম হয়েছে। এর মধ্যে ১ ও ২ নং অভিযোগে আসামিদের আমৃত্যু কারাদন্ড এবং ৩ ও ৫ নম্বর অভিযোগে আসামিদের ফাসিঁতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার রায় দেয়া হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় এ আসামিদের দ্বারা যে নৃশংস অপরাধ সংগঠিত হয়েছে তাতে তাদের মৃত্যুদন্ডের সাজাই প্রাপ্য বলে রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে।
বাদল বলেন,এ আসামিদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, গণহত্যা, অপহরণ, দেশান্তরিতকরণ, বাড়িঘরে আগুন ও লুটপাটের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সর্বোচ্চ এ সাজা দেয়া হয়েছে।আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি আনোয়ারুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল জনাকীর্ণ ট্রাইব্যুনালে মঙ্গলবার এ রায় ঘোষণা করে। গত ১০ জানুয়ারি উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক পেশ শেষে মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমান (সিএভি) রাখা হয়। মঙ্গলবার সকাল সাড়ে দশটার দিকে ২৬৮ পৃষ্ঠার রায়ের সংক্ষিপ্তসার উপস্থাপন শুরু করে ট্রাইব্যুনাল। রায়ের প্রথম অংশ পড়েন বিচারিক প্যানেলের সদস্য বিচারপতি মো. সোহরাওয়ার্দী। রায়ের দ্বিতীয় অংশ পড়েন অন্য সদস্য বিচারপতি শাহিনুর ইসলাম। সবশেষে রায়ের মূল অংশ ও দন্ড ঘোষণা করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি আনোয়ারুল হক।
সরকার ইচ্ছা করলে দন্ডিত তাহের ও ননীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে অথবা ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদন্ডাদেশ কার্যকর করতে পারে। মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত এ দুই প্রক্রিয়ার যেকোনো একটি অবলম্বন করা সরকারের ইচ্ছাধীনও করা হয়েছে বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়।সকাল নয়টার কিছু পরে আসামি তাহের ও ননীকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ট্রাইব্যুনালে আনা হয়। রায় ঘোষণার সময় ট্রাইব্যুনালের হাজতখানা থেকে আসামির কাঠগড়ায় হাজির করা হয়। রায় ঘোষণা উপলক্ষে ট্রাইব্যুনাল ও এর আশপাশের এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়।রায় ঘোষণার সময় ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপুসহ প্রসিকিউশনের অন্যান্য সদস্যও উপস্থিত ছিলেন। এছাড়াও মুক্তিযোদ্ধাসহ বিপুল সংখ্যক গণমাধ্যম কর্মী ট্রাইব্যুনালের এজলাস কক্ষে উপস্থিত ছিলেন।প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম সাংবাদিকদের বলেন, ট্রাইব্যুনাল আজ রায় প্রদানকালে বলেছে মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ শহীদ নিয়ে বির্তকের কোন অবকাশ নেই। এ রায়ের মধ্য দিয়ে শহীদ পরিবারের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেছে। এ রায় শহীদ পরিবারের জন্য স্বস্তি ও শান্ত¦না। দীর্ঘ সময় পর হলেও ন্যায়বিচার পেয়েছে শহীদ পরিবার।
এদিকে, একাত্তরে হত্যা, ধর্ষণের মতো যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসির রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার কথা বলেছেন নেত্রকোণার দুই রাজাকার মো. ওবায়দুল হক ওরফে আবু তাহের ও আতাউর রহমান ননীর আইনজীবী।মঙ্গলবার রায়ের পর তাদের আইনজীবী গাজী এমএইচ তামিম বলেন, ট্রাইব্যুনাল যে রায় দিয়েছেন, তাতে উনারা সংক্ষুব্ধ হয়েছেন। এই রায়ের বিরুদ্ধে উনারা সুপ্রিম কোর্টের আপিল করবেন।আপিলে তারা নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে খালাস পাবেন বলেও আশা প্রকাশ করেন এই আইনজীবী।
বিচারপতি আনোয়ারুল হক নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল যে রায় দিয়েছে তাতে প্রসিকিউশনের আনা ছয়টি অভিযোগের মধ্যে চারটিতে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন একাত্তরের এ দুই রাজাকার সদস্য। তাদের ফাঁসির রায় এসেছে হত্যা ও ধর্ষণের দুটি ঘটনায়।গাজী তামিম বলেন, যে চার অভিযোগে তাদের অভিযুক্ত করা হয়েছে, সবগুলোতে তারা খালাস পাওয়ার যোগ্য। ১৯৭১ সালে আতাউর রহমান ননী অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন। একজন অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থীর পক্ষে এতো বড় জঘন্য অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকা একেবারেই অস্বাভাবিক বলে আমরা মনে করি।আরেকজন (তাহের) ডিগ্রির ছাত্র ছিলেন। একজন সাক্ষীর বয়স তখন ছিল এক বছর, অন্যজনের বয়স তিন বছর ছিল। নেত্রকোণায় অনেক মুক্তিযোদ্ধা, অনেক বয়স্ক লোক ছিল। তাদের না এনে প্রসিকিউশন এই রকম মাইনরদের এনে সাক্ষী বানিয়েছে।
প্রসিকিউশনের অভিযোগপত্রে বলা হয়, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তাহের ছিলেন নেজামী ইসলামী পার্টির স্থানীয় নেতা। চার দশক পরে যুদ্ধাপরাধের দায়ে গ্রেপ্তার হওয়ার সময় বিএনপির রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন তিনি।তাহের ও ননী একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন এবং পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীকে সহযোগিতা করতে গঠিত রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেন।
সে সময় নেত্রকোণা জেলা সদর ও বারহাট্টা থানাসহ বিভিন্ন এলাকায় তারা মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্য তারা ‘কুখ্যাত রাজাকার’ হিসেবে পরিচিতি পান বলে এ মামলার বিচারে উঠে এসেছে।আসামিপক্ষের সাফাই সাক্ষী না থাকার বিষয়ে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে গাজী তামিম বলেন, প্রসিকিউশন যে সব সাক্ষীর মাধ্যমে মামলা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে, ডিফেন্স মনে করেছে, এই সাক্ষ্যের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ডের মতো কিছু হবে না। এ কারণেই আমরা এ ধরনের সাবমিশন করেছি।আমরা সাফাই সাক্ষী দেইনি, কারণ আমরা মনে করেছি, প্রসিকিউশন কোনোভাবেই এ মামলা প্রমাণ করতে পারবে না।
নিয়ম অনুযায়ী এক মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ আদালতে আপিলের সুযোগ পাবেন তাহের ও ননী।গত বছরের ২ মার্চ এ আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। গত বছরের ৫ এপ্রিল তাদের বিরুদ্ধে সূচনা বক্তব্য পেশ ও সাক্ষ্যগ্রহণ শুরুর মধ্য দিয়ে মামলার বিচার শুরু হয়। মামলায় প্রসিকিউশনের পক্ষে ২৩ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়। আসামিপক্ষ কোন সাক্ষি হাজির করতে পারেনি।মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ওবায়দুল হক তাহের ও আতাউর রহমান ননীর বিরুদ্ধে ২০১৪ সালের ৪ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) আমলে নেয় ট্রাইব্যুনাল। এ দুজনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের চারটি সুনির্দিষ্ট ঘটনায় অভিযোগ আনা হয়েছে। অভিযোগের মধ্যে রয়েছে হত্যা, অপহরণ, আটক, নির্যাতন ও লুট। এ দুই আসামির বিরুদ্ধে হত্যা, প্রায় ৫’শ এর মতো বাড়ীঘর লুট ও অগ্নিসংযোগে সাক্ষ্য-প্রমাণ পেশ করেছে প্রসিকিউশন।
আসামি রাজাকার ওবায়দুল হকের বাড়ী নেত্রকোনার আটপাড়ায় ও আতাউর রহমানের বাড়ী কেন্দুয়া এলাকায়। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ২০১৪ সালের ১২ আগস্ট নেত্রকোনা পুলিশ এ দুই আসামিকে গ্রেফতার করে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় এ দুই আসামি বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় এবং পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীকে সহযোগিতা করতে গঠিত রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় নেত্রকোনা জেলা সদর ও বারহাট্রাসহ জেলার বিভিন্ন এলাকায় মানবতাবিরোধী কর্মকান্ডের জন্য তারা কুখ্যাত রাজাকার’ হিসেবে পরিচিতি পায়। ওবায়দুল হক তাহের স্থানীয় রাজাকার বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে ননীসহ অন্যান্য রাজাকার সদস্যদের নিয়ে নেত্রকোনা শহরের মোক্তার পাড়ার বলয় বিশ্বাসের বাড়ি দখল করে সেখানে রাজাকার ক্যাম্প স্থাপন করেছিল। মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িতদের বিচারে গঠিত পৃথক দুটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত ২১ মামলায় ২৪ আসামির বিরুদ্ধে রায় হয়েছে। নেত্রকোনার মো. ওবায়দুল হক তাহের ও আতাউর রহমান ননীর বিরুদ্ধে মামলায় রায় ট্রাইব্যুনালের ২২ তম রায়। একটি ট্রাইব্যুনাল হওয়ার পর এটি প্রথম রায়। এ পর্যন্ত রায় আসা ২২টি মামলার ২৬ আসামির মধ্যে তাহের ও ননীকে নিয়ে মোট ১৮ যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ সাজার আদেশ হল।
Discussion about this post