একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামালপুরের আট রাজাকার-আলবদরের মধ্যে তিনজনকে মৃত্যুদণ্ড ও পাঁচজনকে আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।
ফাঁসির আদেশপ্রাপ্তরা হলেন- আলবদর বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ আশরাফ হোসাইন, মোহাম্মদ আবদুল মান্নান ও মোহাম্মদ আবদুল বারী। আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন- জামালপুর জেলা জামায়াতের সাবেক আমির অ্যাডভোকেট শামসুল আলম ওরফে বদর ভাই ও সাবেক জামায়াত নেতা এস এম ইউসুফ আলী, অধ্যাপক শরীফ আহমেদ ওরফে শরীফ হোসেন, মো. হারুন ও মোহাম্মদ আবুল হাসেম।
আসামিদের বিরুদ্ধে হত্যা, গণহত্যা, আটক, অপহরণ, নির্যাতন, লুটপাট ও মরদেহ গুমের পাঁচটি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়। এসব অভিযোগের মধ্যে ১ ও ৫ নম্বর বাদে বাকি তিনটিই প্রমাণিত হওয়ায় এসব সাজা দেন ট্রাইব্যুনাল। আসামিদের মধ্যে আশরাফ হোসেন, আব্দুল মান্নান ও আব্দুল বারী ২ নম্বর অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড ছাড়াও অন্য দুই অভিযোগে (৩ ও ৪ নম্বর) দু’বার করে আমৃত্যু কারাদণ্ড পেয়েছেন। শরীফ হোসেন ৩টি অভিযোগেই এবং মো. আবুল হাশেম, শামসুল হক ও এস এম ইউসুফ আলী একটিতে (৩ নম্বর) এবং মো. হারুন একটিতে (২ নম্বর) আমৃত্যু কারাদণ্ড পেয়েছেন।
সোমবার (১৮ জুলাই) সকালে একই মামলার ওই আট আসামির মামলার রায় দেন চেয়ারম্যান বিচারপতি আনোয়ারুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। বিচারিক প্যানেলের অন্য দুই সদস্য হলেন বিচারপতি শাহিনুর ইসলাম ও বিচারপতি মো. সোহরাওয়ারদী। সকাল পৌনে এগারটা থেকে ২৮৯ পৃষ্ঠার রায়ের প্রথম অংশ পড়ে শোনান বিচারপতি শাহিনুর ইসলাম। পরে রায়ের মূল অংশ অর্থাৎ আসামিদের সাজা ঘোষণা করেন চেয়ারম্যান বিচারপতি আনোয়ারুল হক।
রায় শোনাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ট্রাইব্যুনালের এজলাসকক্ষে আসামির কাঠগড়ায় হাজির করা হয় গ্রেফতারকৃত দুই আসামি অ্যাডভোকেট শামসুল আলম ওরফে বদর ভাই ও সাবেক জামায়াত নেতা এস এম ইউসুফ আলীকে। অন্য ছয় আসামি পলাতক। এটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার ২৫তম রায়। সব মিলিয়ে এসব রায়ে ৪৪ যুদ্ধাপরাধীর মধ্যে ২৬ জন মৃত্যুদণ্ডাদেশ এবং বাকি ১৮ জন আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ পেয়েছেন। সর্বোচ্চ আদালতে মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তির পর ইতোমধ্যেই কার্যকর হয়েছে পাঁচ শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি।
আট আসামির মধ্যে গ্রেফতার হওয়া দু’জন মুক্তিযুদ্ধে রাজাকার বাহিনীর সদস্য ছিলেন। পলাতক বাকি ছয়জন ছিলেন আলবদর বাহিনীর। মামলাটির প্রধান আসামি পলাতক আশরাফ হোসেন আলবদর বাহিনীর জামালপুর মহকুমা কমান্ডার ছিলেন। তার মাধ্যমেই মূলত ইসলামী ছাত্রসংঘের বাছাই করা কর্মীদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের কিলিং স্কোয়াড আলবদর বাহিনী গঠিত হয়।
আট রাজাকার-আলবদরের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলোর মধ্যে ছিল জামালপুরে রাজাকার-আলবদর বাহিনী ও শান্তি কমিটি গঠন, স্থানীয় সাধনা ঔষধালয় দখল করে আলবদর বাহিনী ও শান্তি কমিটির কার্যালয় স্থাপন এবং সিংহজানি হাইস্কুলে আলবদরদের প্রশিক্ষণ প্রদান। এছাড়া ছিল পিটিআই হোস্টেল ও আশেক মাহমুদ কলেজের ডিগ্রি হোস্টেল দখল করে নির্যাতন কেন্দ্র গড়ে সেগুলোতে ১০ হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা-গণহত্যা, আটক, অপহরণ, নির্যাতন ও গুম।
এর মধ্যে কয়েকটি বাড়ি ও টর্চার ক্যাম্পে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন (২ নম্বর), শহীদ নুরুল আমীনকে অপহরণ করে হত্যা (৩ নম্বর) এবং আইয়ুব আলী ফকিরকে নির্যাতন করে হত্যার (৩ নম্বর) দায় প্রমাণিত হয়েছে আসামিদের বিরুদ্ধে। তবে ১০ হাজারের বেশি লোককে হত্যা ও ৭৫ হাজার ঘর-বাড়ি ধ্বংস (১ নম্বর) এবং চারজনকে হত্যার (৫ নম্বর) অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পারেননি প্রসিকিউশন।
প্রমাণিত দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, আসামি আশরাফ হোসেন, শরীফ আহমেদ, আব্দুল মান্নান, মো. হারুন ও আব্দুল বারী ১৯৭১ সালের ৭ জুলাই থেকে ১৪ জুলাই এবং ২২ জুলাই মধ্যরাত পর্যন্ত জামালপুরের সরিষাবাড়ী থানার মইষ ভাদুরীয়া ও ধূপদহ গ্রামের শহীদ আব্দুল হামিদ মোক্তারের বাড়ি, মো. সাইদুর রহমান ভূঁইয়ার বাড়ি, আমির আলী খানের বাড়ি, পিটিআই হোস্টেলের টর্চার ক্যাম্প, জামালপুর শ্মশানঘাটে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেন।
এ অভিযোগে আশরাফ হোসেন, আব্দুল মান্নান ও আব্দুল বারীকে মৃত্যুদণ্ড এবং মো. হারুন ও শরীফ আহমেদকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। তৃতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ১০ জুলাই রাত ৩টার দিকে আসামি শরীফ আহমেদ, আশরাফ হোসেন, আব্দুল মান্নান, আব্দুল বারী, আবুল হাসেম, শামসুল হক ও ইউসুফ আলী জামালপুরের সিঅ্যান্ডবি রোডের দয়াময়ী লেনের মল্লিক ভিলা থেকে শহীদ নুরুল আমীনকে অপহরণের পর ওই দিনই তাকে হত্যা করেন। এ অভিযোগে সব আসামিই পেয়েছেন আমৃত্যু কারাদণ্ড।
চতুর্থ অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ২২ এপ্রিল থেকে ১১ ডিসেম্বর আসামি আশরাফ হোসেন, শরীফ আহমেদ, আব্দুল মান্নান ও আব্দুল বারী জামালপুরের আশেক মাহমুদ ডিগ্রি কলেজের নির্যাতন কেন্দ্রে আইয়ুব আলী ফকিরকে আটকে রেখে নির্যাতন করে হত্যা করেন। এ অভিযোগে সব আসামিই পেয়েছেন আমৃত্যু কারাদণ্ড।
প্রমাণিত না হওয়া প্রথম অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ২২ এপ্রিল থেকে ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ের মধ্যে আসামি ইউসুফ আলী ও শামসুল হক তৎকালীন জামালপুর মহকুমায় ১০ হাজার লোককে হত্যা এবং ৭৫ হাজার ঘর-বাড়ি ধ্বংস করেন।
পঞ্চম অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ২২ এপ্রিল থেকে ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে জামালপুরের পিটিআই নির্যাতন কেন্দ্রে শহীদ আব্দুল হামিদ মোক্তার, সাইদুর রহমান ওরফে সাদু চেয়ারম্যান, শহীদ আব্দুল হামিদ খান ও স ম রেজাউল করিমকে আটক রেখে নির্যাতন করে হত্যা করেন আসামি শরীফ আহমেদ, আশরাফ হোসেন, আব্দুল মান্নান, আব্দুল বারী, আবুল হাসেম, শামসুল হক ও ইউসুফ আলী।
Discussion about this post