মুক্তিযোদ্ধা ও পাবনা জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি শিরিন বানু মিতিল আর নেই। বুধবার দিবাগত রাত দেড়টার দিকে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। পরিবারের পক্ষ থেকে মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত করেন শিরিন বানুর ছেলে তাহসিনুর রহমান। হাসপাতালে ভর্তির আগে রাত সাড়ে ১১টার দিকে তিনি হঠাৎ করে হৃদরোগে আক্রান্ত হলে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসকরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। তাঁর বয়স ছিল ৬৫ বছর।
সাহসী এই নারীর জন্ম ১৯৫১ সালের ২ সেপ্টেম্বর পাবনা জেলায়। বাবা খোন্দকার শাহজাহান মোহাম্মদ ও মা সেলিনা বানু। বাবা ছাত্রজীবনে ও ১৯৫২ সাল পর্যন্ত কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মা পাবনা জেলার ন্যাপ সভানেত্রী এবং ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট সরকারের এমপি ছিলেন। রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম হওয়ার ফলে নিজেও ছিলেন রাজনীতিসচেতন। ছোটবেলা থেকেই ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের বাংলা বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী ছিলেন। এ ছাড়া ১৯৭০-১৯৭৩ সাল পর্যন্ত পাবনা জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সভানেত্রী এবং কিছু সময়ের জন্য পাবনা জেলা মহিলা পরিষদের যুগ্ম সম্পাদিকা ছিলেন।
২৫ মার্চ-১৯৭১ সালে দেশের অন্যান্য স্থানের মতো পাবনা জেলাও পাকিস্তানি হানাদারদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। সাধারণ মানুষের ওপর নেমে আসে অবর্ণনীয় অত্যাচার। ২৭ মার্চ জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে শুরু হয় পাল্টা আক্রমণ। ২৭ মার্চ পাবনা পুলিশ লাইনে যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়, সেখানে সর্বস্তরের মানুষ অংশ নেয়। তাই নারী হয়ে শত প্রতিকূলতার মধ্যে তিনি যুদ্ধে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এক আত্মীয়ের কাছে মাত্র ৩০ মিনিটে থ্রি নট থ্রি চালনা শিখে ফেলেন। কিন্তু নারী হিসেবে সে সময়কার সমাজে সম্মুখ যুদ্ধে যাওয়া ছিল খুবই কঠিন ব্যাপার। তাই তিনি শহীদ বীরকন্যা প্রীতিলতাকে অনুসরণ করে পুরুষের পোশাক পরিধান করে পুরুষবেশে যুদ্ধে যোগ দেন।
২৮ মার্চ টেলিফোন এক্সচেঞ্জে ৩৬ পাকিস্তানি সেনার সঙ্গে জনতার এক তুমুল যুদ্ধ হয়। সেই যুদ্ধে তিনি ছিলেন একমাত্র নারী যোদ্ধা। এই যুদ্ধে ৩৬ পাকিস্তানি সেনা নিহত ও দুজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এ ছাড়া ৩১ মার্চ পাবনার পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে একটি কন্ট্রোল রুম স্থাপিত হয়। ৯ এপ্রিল নগরবাড়ীতে প্রচণ্ড যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সে সময় কন্ট্রোল রুমের পুরো দায়িত্বে ছিলেন তিনি।
এর পর ভারতের স্টেটসম্যান পত্রিকার সাংবাদিক মানব ঘোষ তাঁর ছবিসহ পুরুষ সেজে যুদ্ধ করার খবরটি পত্রিকায় প্রকাশ করে দিলে তাঁর পক্ষে আর পুরুষ সেজে যুদ্ধ করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু তাঁর যুদ্ধ থেমে থাকেনি। পরবর্তী সময়ে পাবনা শহর পাকিস্তানি বাহিনী দ্বারা দখল হলে তিনি ২০ এপ্রিল সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ করেন। সেখানে বাংলাদেশ সরকার পরিচালিত একমাত্র নারীদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প গোবরা ক্যাম্পে যোগ দেন। পরে মেজর জলিলের নেতৃত্বে পরিচালিত ৯ নম্বর সেক্টরে যোগ দেন তিনি। শিরিন বানু মিতিলের তিন সন্তান জয়া রহমান, তাহসিনুর রহমান ও তন্বী নওশিন রহমান।
Discussion about this post