১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারের হত্যার ঘটনার সময় কল্যাণপুরে নিহত জঙ্গি সেহজাদ রউফ অর্কের দাদা আব্দুর রউফ তৎকালীন প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা ডিএফআই (বর্তমান ডিজিএফআই) প্রধান ছিলেন। ওই সময়ে কর্নেল জামিল আহমেদের (মরণোত্তর পদোন্নতি পাওয়া ব্রিগেডিয়ার জেনারেল) কাছে দায়িত্ব হস্তান্তরের কথা থাকলেও সময়মতো দায়িত্ব হস্তান্তর না করায় ইতিহাসের পাতায় বারবারই তার নাম ‘বিতর্কিত’ সেনাকর্মকর্তা হিসেবেই হাজির হয়েছে।
পরবর্তী প্রেসিডেন্ট জিয়ার সাথে তার সখ্যতা ছিল সবসময়ই। জিয়ার শাসনামলে ডিএফআইকে ডিজিএফআই করা হলে কে এম আমিনুল ইসলামকে পরিচালক পদে দেওয়া হয়। এর পরপরই অভিযোগ এনে তাকে সেখান থেকে সরানো হলে আব্দুর রউফ পরিচালকের দায়িত্ব পান।
এ বিষয়ে ২০১০ সালে তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল (অব.)কে এম শফিউল্লাহ, (বীর উত্তম) এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের আগে কোনও এক সময় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে একজন এনসিও (নন কমিশনড অফিসার)সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহের লিফলেটসহ ধরা পড়েন। ‘তখন আমি তখনকার প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রফেসর নুরুল ইসলামকে লিফলেটটি সম্পর্কে জানানোর জন্য লিফলেটসহ তার কাছে যাই এবং তারপর আমরা প্রেসিডেন্টের সাথে সাক্ষাৎ করি। প্রেসিডেন্টকে আমরা অনুরোধ করি, সেনাবাহিনীর ইন্টেলিজেন্স ডিরেক্টরেট গঠনের প্রস্তাবটা তিনি যেন যত দ্রুত সম্ভব পাস করেন এবং যত দ্রুত এটা করা যাবে, তত দ্রুতই এর জন্য প্রয়োজনীয় লোকবলকে প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজে লাগানো যাবে’।
তিনি বলেন, আর প্রস্তাবটি পাস হওয়ার আগপর্যন্ত প্রতিরক্ষামন্ত্রী ডিএফআইকে আর্মি হেডকোয়ার্টারের অধীনে দেওয়ার জন্যও প্রেসিডেন্টকে অনুরোধ করেন।কিছুক্ষণ নীরবতার পর শেখ মুজিব শফিউল্লাহকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রউফ কি তোমাদের ইন্টেলিজেন্স অ্যাফেয়ার্স সম্পর্কে অবহিত করেন না?’ রউফ তখন ছিলেন ডিএফআইয়ের ডিরেক্টর জেনারেল। শফিউল্লাহ তখন বঙ্গবন্ধুকে এনসিও’র কাছ থেকে উদ্ধারকৃত লিফলেটটি দেখান এবং বলেন যে, তিনি নিশ্চিত নন যে, বঙ্গবন্ধুকে রউফ এই লিফলেটটির সম্পর্কে অবগত করেছেন কিনা।
জানা যায়, রাজধানী কল্যাণপুরে মঙ্গলবার ভোরে পরিচালিত অপারেশন স্টর্ম ২৬ –এ নিহত জঙ্গি সেহজাদ রউফ অর্কের বাবা তৌহিদ রউফও ছিলেন সেনাবাহিনীর ঠিকাদার। এমনকি অর্ক নিজেও সেই অস্ত্র ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের পরিচালক পদে আসীন ছিলেন। পুলিশ জানায়, মঙ্গলবার পুলিশের অভিযানে নিহত অর্ক যুক্তরাষ্ট্রের পাসপোর্টধারী বাংলাদেশি।
অস্ত্রব্যবসার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিউ ভিক্টর লিমিটেড (এনভিএল) নামে একটি প্রতিষ্ঠান ১৯৭৭ সালে তার বিতর্কিত দাদা গড়ে তুলেছিলেন। উইকিলিকস কর্তৃক ফাঁস করা মার্কিন যুক্তরাস্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের গোপন নথি (৮ সেপ্টেম্বর ২০০৯) অনুসারে, ১৯৭৭ সালের ৬ এপ্রিল ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.)আব্দুর রউফ এনভিএল গড়ে তোলেন। তার ছেলে তৌহিদ রউফ ১৯৮৮ সাল থেকে এই কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কর্মরত আছেন। আর অর্ক এখানে পরিচালক পদে ছিলেন।
ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, একের পর এক বের হয়ে আসছে আব্দুর রউফের নাতি, কুখ্যাত মোনায়েম খানের নাতিরা এসব জঙ্গি তৎপরতায় জড়িত হয়েছে। একবারের মুক্তিযোদ্ধা আজীবন মুক্তিযোদ্ধা নন, তার আদর্শে পরিবর্তন আসতে পারে। কিন্তু একবারের রাজাকার আজীবন রাজাকার। বংশ পরম্পরায় তাদের এই আদর্শ পরিবাহিত হচ্ছে। তিনি বলেন, এই আব্দুর রউফ জিয়ার মদদপুষ্ট ছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তার দায়িত্বে এসব পাকিস্তানপন্থীরা জায়গা করে নিয়েছিল বলেও মন্তব্য করেন শাহরিয়ার কবির। সেহজাদ রউফ অর্কর জীবন বৃত্তান্ত থেকে তার কোম্পানির কাজ সম্পর্কে জানা যায়। তিনি লিখেছেন, ‘আমরা (এনভিএল)এই ব্যবসা ক্ষেত্রে সবচেয়ে পুরোনো কোম্পানি: আমরা বিদেশ থেকে (চীন, ইংল্যাণ্ড, ইতালি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, কোরিয়া, সাউথ আফ্রিকা)পুলিশ, আর্মি, র্যাব, নৌবাহিনীর কাছে টেণ্ডার অনুযায়ী সেনা প্রতিরক্ষা সরঞ্জামাদি সরবরাহ করি’।
গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারির হামলার ঘটনায় যৌথবাহিনীর অভিযানে নিহত নিবরাসের ঘনিষ্ঠ বন্ধুও ছিলেন অর্ক বলে ইতোমধ্যে নিশ্চিত করেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গত ফেব্রুয়ারি থেকে তিনি নিখোঁজ ছিলেন বলে পরিবারের দাবি। তার বাসা রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় (বাসা -৩০৪, রোড -১০, ব্লক-সি)। তার নিখোঁজের ঘটনার পর ভাটারা থানায় একটি জিডি করে তার পরিবার। জিডি নম্বর-৩৯২।
এ বিষয়ে কথা বলতে তার বাবা তৌহিদ রউফের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি দুদফা ফোন ধরলেও সাংবাদিক শুনে আর কথা বলতে চাননি। তবে তিনি ২৭ জুলাই ওয়াশিংটন পোস্টে জানিয়েছেন, তার ছেলের জন্ম বাংলাদেশে হলেও বেশির ভাগ সময় ইলিনয় ও ক্যালিফোর্নিয়ায় কাটিয়েছে। তিনি বলেন, নিঁখোজ হওয়ার আগে কোনও চিহ্ন বুঝতে পারেননি তারা।
Discussion about this post