একাত্তরের নৃশংস হত্যাকারী বাহিনী আলবদর নেতা ও জামায়াতের অর্থ জোগানদাতা মীর কাসেম আলীর ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছেদ। শনিবার রাত ১০টা ৩৫ মিনিটে কাশিমপুর কারাগারে তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে বলে আইজি প্রিজনস বি. জে. সৈয়দ ইফতেখার উদ্দীন নিশ্চিত করেছেন। এর মধ্য দিয়ে একাত্তরে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ষষ্ঠ অপরাধীর ফাঁসি কার্যকর করা হলো। এর আগে বিকাল চারটা ১৫ মিনিটে মীর কাসেমের সঙ্গে শেষ দেখা করতে কাশিমপুর কারাগারে যান তার পরিবারের ৪৭ সদস্য। তারা পাঁচটা ৫০মিনিটে বেরিয়ে আসেন। এসময়েই কারাগারে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের নির্বাহী আদেশ পাঠানো হয় বলে জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী খাঁন আসাদুজ্জামান মিয়া।
এদিকে বৃহস্পতিবার বিকাল বেলা ২ টার দিকে কারা অধিদফতরের অতিরিক্ত আইজি প্রিজন লে. ক. ইকবাল হাসান, চারটায় ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি প্রিজন গোলাম হায়দার, সন্ধ্যা সাতটার দিকে আইজি প্রিজন বি. জে. সৈয়দ ইফতেখার উদ্দিন কাশিমপুর কারাগারে প্রবেশ করেন। কাশিমপুর কারাগার-২ সূত্র জানায়, শনিবার দুপুরের পর কারাগারের ভেতরে মঞ্চে চূড়ান্ত মহড়ায় চার জল্লাদ অংশ নেন। তারা হলেন শাহজাহান, দ্বীন ইসলাম, রিপন ও শাহীন।
এর আগে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দোষী সাব্যস্ত জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোল্লা এবং বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে।
ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মীর কাসেম ১৯৮৫ সাল থেকে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ অর্থাৎ মজলিসে শূরার সদস্য হিসেবে দলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছিলেন। তিনি হলেন জামায়াতের পঞ্চম শীর্ষ নেতা, চূড়ান্ত রায়েও যার সর্বোচ্চ সাজার সিদ্ধান্ত এসেছে।
এর আগে গত ৩০ আগস্ট মীর কাসেমের আপিল রিভিউ আবেদন খারিজ হয়ে গেলে চূড়ান্ত রায়ে মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে। এরপর রাষ্ট্রপতির কাছে তার প্রাণভিক্ষা চাওয়া বিষয়ে জানতে চাইলে দু’দিন পর শুক্রবার (২ সেপ্টেম্বর) সকালেই প্রাণভিক্ষা না চাওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত করেন তিনি। এরপরই ফাঁসি কার্যকরের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে কাশিমপুর কারা কর্তৃপক্ষ। শনিবার সকাল থেকে কাশিমপুর কারাগার ঘিরে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়।
২০১৪ সালের ২ নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে মীর কাসেমকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এরপর গত ৮ মার্চ আপিলের রায়ে ওই সাজাই বহাল থাকে। ৬ জুন পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর তা পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) জন্য ১৯ জুন আবেদন করেন মীর কাসেম। রাষ্ট্রপক্ষ এরপর রিভিউ শুনানির দিন ধার্যের জন্য আবেদন করে। এর ধারাবাহিকতায় ২১ জুন চেম্বার বিচারপতি বিষয়টি নিয়মিত আপিল বেঞ্চে শুনানির জন্য পাঠান। মুক্তিযুদ্ধকালীন চট্টগ্রামের কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দিন আহমেদসহ আটজনকে হত্যার দুটি ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তখনকার আলবদর কমান্ডার মীর কাসেমকে ২০১৪ সালের ২ নভেম্বর মৃত্যুদণ্ড দেন আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল।
মীর কাসেমের নেতৃত্বে চট্টগ্রামে যে ভবনটিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষের লোকদের ধরে নিয়ে নির্যাতন চালানো হতো, সেই ডালিম হোটেলকে রায়ের পর্যবেক্ষণে ‘ডেথ ফ্যাক্টরি’ বলা হয়। রায়ে বলা হয়, ‘আলবদর সদস্য ও পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে ডালিম হোটেলে নিয়ে আসতো আমৃত্যু নির্যাতন করার উদ্দেশ্যেই। এটাও প্রমাণিত যে, ডালিম হোটেলে আলবদর সদস্যদের পরিচালনা ও নির্দেশনা দিতেন মীর কাসেম আলী নিজে।’ ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধকালীন চট্টগ্রামে মানবতাবিরোধী অপরাধের ১৪টি অভিযোগ এনেছিল প্রসিকিউশন। এর মধ্যে ১১ ও ১২ নম্বর অভিযোগে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
এর মধ্যে ১১ নম্বর অভিযোগে আপিলেও মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে। এ অভিযোগে বলা হয়, মীর কাসেমের পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা মুক্তিযোদ্ধা জসিমকে অপহরণ করে আন্দরকিল্লার ডালিম হোটেলে নিয়ে নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যার পর তার এবং আরও পাঁচজনের লাশ কর্ণফুলী নদীতে ফেলে দেওয়া হয়।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ বলেন, ‘আমার মনে হয় এ রায় কাযকরের মধ্য দিয়ে একাত্তরের শীর্ষস্থানীয় অপরাধী বলয়ের বিচার সম্পন্ন হলো। তার মানে এই নয় যে, কাজ শেষ হয়েছে। বিচার অব্যাহত রাখতে হবে। এই অপরাধীরা যে ভাবাদর্শে অপরাধ করেছে তারও বিচার করতে হবে।’
Discussion about this post