ঝিনাইদহের হরিণাকুন্ডুতে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় চিহ্নিত রাজাকারদের নাম উঠে এসেছে। অথচ নিয়মিত ভাতাসহ সব ধরনের সুযোগ সুবিধা ভোগ করছেন তারা। বিষয়টি জানাজানি হওয়ায় ভূয়াদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ও চিহ্নিত রাজাকার যাচাই-বাছাই কমিটিতে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কাগজপত্র পেশ করায় পুরো উপজেলা জুড়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। খোদ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের দায়িত্বে থাকা মুক্তিযোদ্ধারাই এসব বিতর্কিত মানুষের কাছ থেকে অনৈতিকভাবে লাখ লাখ টাকার সুবিধা নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ করে দিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয় ১৩ এপ্রিল ২০১৭ তারিখে জারিকৃত পত্রে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ে যে দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন তা সম্পূর্নভাবে উপেক্ষা করা হচ্ছে। এতে উপজেলার প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। ভাতুড়িয়া গ্রামের ডাঃ রইচ উদ্দীন স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পিচ কমিটির সদস্য হিসেবে রাজাকারদের সহায়তা করেছেন বলে জানান প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা। সেই রাজাকার ভোল পাল্টিয়ে অর্থের বিনিময়ে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নাম উঠিয়ে নিয়মিত ভাতা তুলে যাচ্ছেন। এছাড়া ডাঃ রইচ উদ্দীন, সিদ্দিক চেয়ারম্যান, আশরাফ মাষ্টারসহ একাধিক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটির সামনেও হাজির হন। তারা কমিটির সামনে কোন প্রমানাদি উপস্থাপন করতে পারেনি। এটি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য চরম অপমানের।
গেজেট মোতাবেক হরিণাকুন্ডু উপজেলায় ২৩৪ জন মুক্তিযোদ্ধার নাম তালিকা ভুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে ৬৬ জন ভুয়া বা অমুক্তিযোদ্ধা। উপজেলার ভাতুড়িয়া গ্রামের ডাঃ রইচ উদ্দিনসহ চিহ্নিত রাজাকার ও পিচ কমিটির সদস্য রয়েছেন বেশ কয়েকজন। ২০১৩-২০১৪ সালে প্রকাশিত গেজেট মোতাবেক যারা তালিকাভূক্ত হয়েছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিরা হলেন-উপজেলার ভাতুড়িয়া গ্রামের ডাঃ রইচ উদ্দিন, আহাদ নগর গ্রামের ওমর আলী, ফলসী গ্রামের মনিরুজ্জামান। এছাড়াও ২০০৫ সালের ১ ডিসেম্বর তারিখে বিএনপি জোট সরকারের সময়ে হরিণাকুন্ডু উপজেলায় কমপক্ষে আরো ১৯ জনের নাম তালিকাভুক্ত করা হয়।
সংশ্লি¬ষ্ট সুত্র জানায়, এ উপজেলায় ২৩২ জনের মধ্যে ২০৪ জন মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবার মাসিক সম্মানী ভাতা পেয়ে থাকেন। মাসিক ১০ হাজার টাকা করে সম্মানী গ্রহন করে থাকেন তারা। ২০৩ জনের মধ্যে ২৭ জন মুক্তিযোদ্ধার বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান, মৃত্যু বরনের কারনে, এবং ওয়ারেশ না থাকায় ভাতা বঞ্চিত রয়েছেন। আবার ৬৬ জন মুক্তিযোদ্ধার লাল মুক্তি বার্তা নেই। এছাড়া অনেক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার নাম সরকারী গেজেট, অতিরিক্ত গেজেট, বিশেষ গেজেট ও লাল মুক্তি বার্তায় না থাকলেও অর্থের বিনিময়ে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নাম উঠিয়ে ভাতা উত্তোলন করে যাচ্ছেন।
ভাতা প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ৮ জন জামায়াতের সক্রিয় নেতাকর্মী রয়েছেন বলে অভিযোগে জানা যায়। এরা হলেন-উপজেলার ভায়না গ্রামের বুলুবারী, আজিবর রহমান, মোহাম্মদ আলী, জোড়াদহ গ্রামের ডাঃ বারী, কামারখালী গ্রামের আবুবক্কর, ভেড়াখালী গ্রামের শের আলী, শিতলী গ্রামের নাজিম উদ্দীন, পার্বতীপুর গ্রামের আশরাফ আলী মাস্টার। এদের মধ্যে অনেকে আবার পুলিশ হত্যা মামলার আসামী হয়েছেন।
প্রকাশিত গেজেট সুত্রে জানা গেছে, ৬৬ জন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে উপজেলার কাপাশহাটিয়া গ্রামের ইবাদৎ হোসেন, ওসমান খাঁ, আজগর আলী, শিতলী গ্রামের ইবাদৎ হোসেন, শ্রীপুর গ্রামের জানু চেয়ারম্যান, বাক্কা সরকার, মিজানুর রহমান মন্টু, ছবের আলী, দোবিলা গ্রামের মোশাররফ হোসেন, রামনগরের আমিরুল, জোড়াদহ গ্রামের লিয়াকত আলী, জিয়াউদ্দীন, হরিশপুর গ্রামের আব্দুল লতিফ, ইজাল উদ্দীন, আইয়ুব বিডিআর, ভায়না গ্রামের ইছাহক, পোলতাডাঙ্গা গ্রামের আব্দুল হাকিম মোল্লা, রঘুনাথপুরের আবু মুসা, এ্যাড. মফিজুর রহমান কাকু, কালাপাহাড়িয়া গ্রামের মুনিব আলী, কেষ্টপুরের ইসাহক আলী, সোনাতনপুর গ্রামের সাবেক চেয়ারম্যান আবুবকর সিদ্দিক, নতিডাঙ্গা গ্রামের আনসার আলী, ভাতুড়িয়া গ্রামের জাহাঙ্গীর হোসেন, মুসা ফকির, বাসুদেবপুর গ্রামের আফজাল হোসেন, গাড়াবাড়িয়া গ্রামের গহর আলী, নারায়নকান্দি গ্রামের মোস্তাফিজুর রহমান।
বিগত ৬ বছরে উপজেলায় অর্ধ ডজন মুক্তিযোদ্ধার নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে বলে মুক্তিযোদ্ধা অফিস সূত্র জানিয়েছে। তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, কোটায় চাকরি, মাসিক ভাতা এবং মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় মর্যাদা লাভের জন্য স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় যারা ৮-৯ বছরের শিশু এবং রাজাকার হিসেবে চিহ্নিত তারাও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভূক্ত হয়েছে। এছাড়া সোনাতনপুর গ্রামের সাবেক চেয়ারম্যান আবুবকর সিদ্দিকের ৩ ছেলে ১ মেয়ে ও ভাতুড়িয়া গ্রামের মুসা ফকিরের সন্তান ভুয়া সনদে কোটায় পুলিশে চাকরী নিয়েছেন। এ সব তদন্ত হওয়া জরুরী বলে মনে করেন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা। সিদ্দিক চেয়ারম্যানের সনদ বাতিল, চাকরির সুষ্ঠু তদন্ত ও ভাতা বন্ধের দাবি জানিয়ে এলাকাবাসির পক্ষে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়, জেলা প্রশাসক ও দুদকসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন দৌলতপুর ইউনিয়ন আ’লীগের সভাপতি ছাব্দার রহমান।
এ বিষয়ে জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার মকবুল হোসেনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি জানান, বর্তমান সময়ে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল থেকে অনেকেই তালিকাভূক্ত হয়েছেন। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা পেয়ে যাচাই-বাছাই শেষ পর্যায়ে। ভুয়াদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান তিনি। এক প্রশ্নের জবাবে জেলা কমান্ডার আরও বলেন, বিভিন্ন সময়ে ভূয়া মুক্তিযোদ্ধাসহ রাজাকারদের নাম তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এ অবস্থায় প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ষার জন্য প্রভাবমুক্ত সুষ্ঠু যাচাই-বাছাই জরুরি বলে মনে করেন তিনি। উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মোঃ কৌশিক খান সূত্রে জানা গেছে, ২০৪ জন মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবার মাসিক সম্মানী ভাতা পেয়ে থাকেন। প্রতি মাসে ২০ লাখ ৪০ হাজার টাকা সরকার থেকে বরাদ্দ দেয়া হয়।
এছাড়া টাকার বিনিময়ে আরো ১৯৮ জনের একটি খসড়া তালিকা প্রস্তুত করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে উপজেলা কমান্ডার মহিউদ্দীন আহম্মেদের বিরুদ্ধে। যা ৩০ এপ্রিলের মধ্যে যাচাই-বাছাই করে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে। অমুক্তিযোদ্ধা ও ভুয়াদের নাম তালিকা থেকে বাদ দিয়ে উত্তোলন করা মাসিক ভাতার টাকা সরকারী কোষাগারে ফেরৎ নেয়ার দাবী জানিয়েছেন হরিণাকুন্ডু উপজেলার প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাগন।
হরিণাকুন্ডু উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটির সভাপতি নুর উদ্দীন আহম্মেদ জানান ভুয়াদের তালিকা প্রস্তুত শেষ পর্যায়ে। উপজেলায় ১৯৮ জনের মধ্যে প্রায় ৭০ জন যাচাই বাছাইয়ে সঠিক বলে প্রতিয়মান হয়েছে। খুব দ্রুত সময়ের (৭ দিনের) মধ্যে চুড়ান্ত তালিকা টাঙিয়ে দেওয়া হবে। তবে যাচাই-বাছাই কমিটির দু একজন সদস্য ভুয়াদের পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় ভুয়াদের বাদ দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে বলে তিনি জানান। যাচাই-বাছাই কমিটির সদস্য সচিব উপজেলা নির্বাহী অফিসার মনিরা পারভীন জানান, যে সমস্থ মুক্তিযোদ্ধারা ভুয়া, রাজাকার এবং স্বাধীনতা বিরোধী চক্্েরর সাথে জড়িত ও পিচ কমিটির সদস্য তাদের ভাতা অবশ্যই বন্ধ হওয়া উচিৎ। স্বাধীনতা বিরোধীদের ভাতা বন্ধ এবং সরকারী সমস্থ সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া উচিত বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন।
স্টাফ রিপোর্টার,ঝিনাইদহ
Discussion about this post