আজ ৫ মে , গোপালপুর গণহত্যা দিবস দেড়শ’ মানুষের হত্যাযজ্ঞ ও বধ্যভূমি থেকে ফিরে আসা একজনের আক্ষেপ
আজ ৫ মে৷ গোপালপুর গণহত্যা দিবস৷ একাত্তরের এ দিনে একসঙ্গে দেড়শ’ মানুষকে নর্থবেঙ্গল সুগার মিল চত্বরের পুকুর পাড়ে জড়ো করে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করা হয়৷ এরমধ্যে মিলের প্রশাসক লেফটেন্যান্ট (অব) আনোয়ারুল আজিমসহ ছিল ৯০ কর্মকর্তা-কর্মচারী৷ স্বাধীনতার পর এক সাগর রক্ত ধারণ করেছে বলে ওই পুকুরের নাম দেয়া হয় শহীদ সাগর৷ দিনটি স্মরণে প্রতিবছর শহীদ সাগরে সমবেত হয় শহীদদের স্বজনরা৷ তারা শহীদ স্মৃতিসৌধে পুষ্পমাল্য অর্পন করে৷ শহীদদের আত্মার শান্তি কামনায় মিলের শ্রমিক-কর্মচারীরা আয়োজন করে কাঙালী ভোজের৷ এ বছরও অনুরূপ আয়োজনের মধ্য দিয়ে দিনটি স্মরণ করছে স্থানীয়রা৷ সেদিনের সেই হত্যাযজ্ঞে লাশের স্তুপের মধ্যে পড়ে থেকেও ভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছিলেন মিলের কর্মচারী খন্দকার জালাল আহমেদ৷ ঘটনার স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, মুলত ময়না যুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতেই হানাদার বাহিনী ৫ মে সুগার মিল চত্বরে হত্যাযজ্ঞ চালায়৷ ৩০ মার্চ লালপুরের ময়না গ্রামে সম্মুখ যুদ্ধে মুক্তিপাগল বাঙালি-সাঁওতাল তীর-ধনুক হাতে হানাদারদের মোকাবিলা করে৷ তাদের সঙ্গে যোগ দেয় ইপিআর ও আনসার বাহিনীর সদস্যরা৷ যুদ্ধে সাঁওতাল তীরন্দাজসহ শহীদ হয় ৪০ মুক্তিযোদ্ধা৷ বাঙালিদের হাতে ধরা পড়ে মেজর রাজা আসলামসহ ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সদস্য৷ তাদের পরে গুলি করে হত্যা করা হয়৷
নর্থবেঙ্গল সুগার মিলের পাওয়ার হাউজে এসবিএ পদে কর্মরত ছিলেন খন্দকার জালাল৷ বিভীষিকাময় সে দিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বার বার আনমনা হয়ে পড়ছিলেন৷ তিনি বলেন, একাত্তরের ৫ মে আনুমানিক সকাল সাড়ে ১০টা৷ মিলে ডিউটি করছি৷ এ সময় দুই হানাদার আমার দু’ পাশে এসে দাঁড়ায়৷ তাদের সঙ্গে ছিল মিলের অবাঙালি কর্মচারী মঞ্জুর ইমাম৷ তার মাথায় ছিল সাদা রুমাল বাঁধা৷ মিলের অবাঙালি কর্মচারীরা সেদিন মাথায় সাদা রুমাল বেঁধে হানাদারদের জানান দেয়, তারা ‘বাঙালি’ নয়৷ জালাল বলেন, একজন আমার পিঠে রাইফেল ঠেকিয়ে বলে- ইয়ে বাঙ্গালি চলো, মিটিং হোগা, মিটিং মে চলো৷ হানাদারদের সঙ্গে জালাল এসে দেখেন, মিলের প্রশাসক লে. আনোয়ারুল আজিমসহ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ধরে এনে মিল চত্বরের ফাঁকা জায়গায় মাটিতে বসিয়ে রাখা হয়েছে৷ হানাদারদের অফিসার আনোয়ারুল আজিমকে লক্ষ্য করে প্রশ্ন করে, মেজর আসলাম কো কেয়া হুয়া? কিসনে মারা গেয়া? আনোয়ারুল আজিম ঘাড় নেড়ে বলেন, তিনি জানেন না৷ এরপর মিলের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ অন্তত দেড়শ’ লোককে পুকুর পাড়ে নিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করায় হানাদারের দল৷ এরমধ্যে খন্দকার জালাল আহমেদ ও তাঁর সহোদর আবদুল মান্নান এবং তাদের বাবা খন্দকার ইমাদউদ্দিন আহমেদও ছিলেন৷ জালাল বলেন, বুঝতে পারলাম অল্প সময়ের মধ্যে আমরা মারা যাচ্ছি৷ ছোটভাই মান্নান আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে কঁকিয়ে ওঠে, ভাইয়া এরা আমাদের মেরে ফেলবে? ছোটভাইয়ের প্রশ্নের জবাবে চোখ ফেটে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে৷ মনের পর্দায় ভেসে ওঠে স্বজনদের মুখ৷ বুকের ভেতরটা ফাঁকা হয়ে যায়৷ একসঙ্গে গর্জে ওঠে ঘাতকদের ১৩টি মেশিনগান৷ একযোগে দেড়শ’ লোকের গগনবিদারী চিত্কারে পুরো আকাশ ভেঙে পড়ে গোপালপুরে৷ লাশের পর লাশ পড়ে পুকুরে৷ বুলেটের আঘাতে সহোদর মান্নানের ঝাঁঝরা হওয়া লাশটি এসে পড়ে জালালের বুকের ওপর৷ চোখে লাগে গরম রক্তের ঝাপটা৷ এক সাগর রক্তের স্রোতধারা মিশে পুকুরের পানি মুহুর্তে রঙ বদলায়৷ মৃতু্য নিশ্চিত করতে হায়েনার দল পুকুর পাড়ে আটকে থাকা লাশ বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে পানিতে গড়িয়ে দেয়৷ জালাল বললেন, গুলি তাঁর গায়ের চামড়া ভেদ করে বেরিয়ে গেলেও ভাগ্যক্রমে তিনি তখনও বেঁচে ছিলেন৷ চোখের নাচুনি দেখে লাশের নিচে থেকে হানাদাররা তাঁকে টেনে বের করে এনে বলে, এ শালে আভি জিন্দা হ্যায়৷ পরে দু’ দু’বার বেয়নেট চার্জ করে মৃতু্য নিশ্চিত ভেবে লাথি মেরে তাঁকে পুকুরের পানিতে ফেলে রেখে যায়৷ হানাদারদের এ হত্যাযজ্ঞের কবলে পড়ে আরও যে ক’জন ভাগ্যক্রমে বেঁচেছিলেন, তাদের মধ্যে মেহমান আলী ও নওশাদ আলীর সহযোগিতায় খন্দকার জালাল মিল চত্বর থেকে বেরিয়ে আসেন৷ তারা জালালকে তুলে প্রাচীরের ওপর দিয়ে বাইরে ফেলে দেন৷ পরে স্থানীয়রা কাঠের তক্তায় ঝুলিয়ে তাকে গ্রামের বাড়ি ময়নায় পেঁৗছে দেয়৷ বেয়নেটের ক্ষত তাঁকে বিজয়ের দিন পর্যন্ত কষ্টের মধ্যে রাখে৷
পরাজয়ের প্রতিশোধ নিয়ে গোপালপুর কাঁপিয়ে চলে যায় হানাদারের দল৷ তারপর সব সুনসান৷ কেউ কোথাও নেই৷ পুকুর পাড়ে নেমে আসে কবরের নিস্তব্ধতা৷ বেয়নেটের খোঁচা খেয়ে খন্দকার জালাল জ্ঞান হারিয়েছিলেন৷ জ্ঞান ফিরে পেয়ে দেখেন, তাঁর মাথা পুকুর ঘাটের পাকা সিঁড়ির ওপর৷ আর দেহটা পানিতে৷ চোখ খুলে এপাশ-ওপাশ মাথা ঘুরিয়ে দেখেন, বেঁচে আছেন সহকর্মী মেহমান আলী৷ তিনি লাশের স্তুপ উল্টে-পাল্টে খুঁজছেন, আর কেউ বেঁচে আছে কিনা৷ সেদিন ভাগ্যক্রমে মিলের আরও যেসব কর্মচারী বেঁচে গিয়েছিলেন, তারা হলেন নওশাদ আলী, খন্দকার ইমাদ উদ্দিন আহমেদ, আবদুল জলিল সিকদার, তোফাজ্জল হোসেন ও আজের আলী৷ শহীদ পরিবারের সদস্য খন্দকার জালাল আহমেদ৷ নিজেও হানাদারদের বধ্যভুমিতে দাঁড়িয়ে ভাগ্যক্রমে বেঁচে আছেন৷ এখনও দেহে বয়ে বেড়াচ্ছেন বেয়নেট-কষ্ট৷ শহীদ পরিবার হিসাবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি মেলেনি বলে মনের গহীনে রয়েছে অভিমানের কষ্ট৷ শুধু তিনি নন, তাঁর ছেলে সোহেলরানা ও বৌমা মলির মনেও এ কারণে জন্মেছে ক্ষোভ৷ পাঁচ ছেলের একটির কপালেও জোটেনি চাকরি৷ এমনকি যে মিলে জালাল তাঁর পুরো কর্মজীবন কাটিয়েছেন৷ যেখানে হারিয়েছেন স্নেহের সহোদর মান্নানকে৷ সেখানেও তাঁর ছেলেদের কপালে শিকে ছেঁড়েনি৷ ছেলে সোহেলরানা আক্ষেপের সঙ্গে বললেন, চাকরির জন্য মুক্তিযোদ্ধা কিংবা শহীদ পরিবারের সদস্য হলেই চলবে না৷ তার জন্য গুনতে হবে লাখ লাখ টাকা৷ যা আমাদের নেই৷ বৌমা মলি ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, দেশে চলছে রাজাকারদের জয়-জয়কার৷ সব সুযোগ-সুবিধা এখন তাদের হাতে৷ কারণ তাদের আছে টাকা৷ এসব কষ্টের কথা লিখে ২০১২ সালের ২৮ জুন খন্দকার জালাল চিঠি পাঠিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে৷ প্রধানমন্ত্রী তাঁর সে চিঠি পেয়েছেন কিনা, তা তিনি জানেন না৷ সব কষ্ট বুকের মধ্যে ধামাচাপা দিয়ে জীবনটাকে এখনও বয়ে বেড়াচ্ছেন জালাল৷
**দৈনিক বার্তা : জিএম ইকবাল হাসান -০৫.০৫.২০১৪